কাঁচা হলুদের উপকারিতা, অপকারিতা এবং খাবার নিয়ম
রান্নাঘরে হোক কিংবা ত্বক পরিচর্যার আমাদের অন্যতম একটি পরিচিত উপাদান হলো হলুদ। আমরা ছোট থেকেই হলুদের গুনাগুন সম্পর্কে কমবেশি সবাই একটু জানি।
শরীরের সমস্যা, ত্বকের সমস্যা, পেটের সমস্যা সবকিছুতেই সমানভাবে কার্যকরী হয় হলুদ। এছাড়াও কোন অনুষ্ঠান বাড়িতে বা শুভ কাজে হলুদের ব্যবহার আমরা সকলেই জানি।
আয়ুর্বেদ চিকিৎসা শাস্ত্রে শুরু থেকেই বিভিন্ন ত্বক পরিচর্যা কারী ওষুধ তৈরি করতে কিংবা স্বাস্থ্যের জন্য প্রয়োজনীয় ওষুধ তৈরি করতে হলুদের ব্যবহার হয়ে চলেছে।
গবেষণায় দেখা গেছে হলুদের প্রচুর পরিমাণে অ্যান্টিঅক্সিডেন্টেন্ড, অ্যান্টিভাইরাল এবং অ্যান্টি ব্যাকটেরিয়াল উপাদান রয়েছে। এছাড়াও অ্যান্টিফাঙ্গার এবং অ্যান্টিডাইবেটিকাল উপাদান সমূহ হলুদের গুনাগুন মাত্রাকে আরো কিছুটা বাড়িয়ে দিয়েছে।
কাঁচা হলুদের পুষ্টি উপাদান
কাঁচা হলুদ একটি ঔষধি গুণসমৃদ্ধ মশলা যা বিভিন্ন ভিটামিন, খনিজ এবং অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট সমৃদ্ধ।
প্রতি ১০০ গ্রাম কাঁচা হলুদে আপনি পাবেন:
- ভিটামিন সি: 53 মিলিগ্রাম (আপনার দৈনন্দিন চাহিদার 88%)
- ম্যাঙ্গানিজ: 2.86 মিলিগ্রাম (আপনার দৈনন্দিন চাহিদার 143%)
- লোহা: 0.58 মিলিগ্রাম (আপনার দৈনন্দিন চাহিদার 32%)
- পটাশিয়াম: 422 মিলিগ্রাম (আপনার দৈনন্দিন চাহিদার 12%)
- ভিটামিন বি6: 0.154 মিলিগ্রাম (আপনার দৈনন্দিন চাহিদার 12%)
- ম্যাগনেসিয়াম: 24 মিলিগ্রাম (আপনার দৈনন্দিন চাহিদার 6%)
- ফাইবার: 3.1 গ্রাম (আপনার দৈনন্দিন চাহিদার 12%)
এছাড়াও কাঁচা হলুদে আরও অনেক গুরুত্বপূর্ণ পুষ্টি উপাদান রয়েছে:
- কার্কিউমিন: এটি হলুদের সক্রিয় উপাদান যা অ্যান্টি-ইনফ্লেমেটরি, অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট এবং ক্যান্সার প্রতিরোধী গুণসম্পন্ন।
- টারমেরিক: এটি হলুদের আরেকটি সক্রিয় উপাদান যা অ্যান্টি-ইনফ্লেমেটরি এবং অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট গুণসম্পন্ন।
- থায়ামিন: এটি শরীরের শক্তি উৎপাদনে সাহায্য করে।
- রিবোফ্লাভিন: এটি ত্বক, চুল এবং চোখের স্বাস্থ্যের জন্য গুরুত্বপূর্ণ।
- নিয়াসিন: এটি শরীরের শক্তি উৎপাদনে সাহায্য করে।
- ফোলেট: এটি গর্ভবতী মহিলাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ।
কাঁচা হলুদের উপকারিতা
লিভার পরিশুদ্ধ করে হলুদ
আমাদের দেহের একটি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ হলো লিভার। হলুদের মধ্যে থাকা অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট উপাদান গুলি যেকোনো ধরনের লিভারের রোগের চিকিৎসা করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
গবেষণায় দেখা গিয়েছে হলুদের মধ্যে থাকা কারকিউমিন উপাদানটি লিভার কে সুরক্ষিত রাখতে পারে। কারকিউমেন্ট মূলত অ্যালকোহল যুক্ত ফ্যাটি লিভারের সমস্যার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে।
ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখে হলুদ
রক্তের শর্করার পরিমাণ নিয়ন্ত্রণে রাখতে অন্যতম একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হলো হলুদ। গবেষণায় দেখা গিয়েছে প্রতিদিন যারা সকালবেলায় খালি পেটে কাঁচা হলুদ খেয়ে থাকেন তাদের দেহের ভেতরে এমন কিছু উপাদানের মাত্রা বৃদ্ধি পেয়েছে।
যার প্রভাবে ডায়াবেটিস রোগীদের ইনসুলিনের কর্ম ক্ষমতা বৃদ্ধি পায় । ফলে রক্তের শর্করার পরিমাণ নিয়ন্ত্রণে চলে এসে যায়। তাই বলা যেতে পারে ডাইবেটিসের মতো মারণ রোগে আক্রান্ত যদি হতে না চান, তাহলে প্রতিদিন সকালে খালি পেটে অবশ্যই কাঁচা হলুদ খেতে হবে।
ক্যান্সার প্রতিরোধ করে হলুদ
ওলন পেড এবং ত্বকের ক্যান্সারের মতো রোগ নিরাময় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে হলুদ। এর মধ্যে থাকা প্রতিরোধ মূলক উপাদানগুলি ক্যান্সার হওয়ার সম্ভাবনা কম করতে পারে। এবং ক্যান্সারের বিস্তারকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারে।
গবেষণায় দেখা গিয়েছে যারা দৈনিক কাঁচা হলুদ খান তাদের বিভিন্ন রকম ক্যান্সার হওয়ার সম্ভাবনা অনেকটাই কমে যায়। এছাড়াও ক্যান্সার কোষের বৃদ্ধি কম করে শরীরকে সুস্থ রাখতে পারে হলুদ।
হলুদের মধ্যে থাকা কারকিউমিন যেকোনো প্রদাহের সঙ্গে লড়াই করে শরীরকে প্রদাহ মুক্ত করে।
ওজন কমাতে সাহায্য করে হলুদ
বর্তমান সময়ে দেহের অতিরিক্ত ওজন নিয়ে আমাদের অনেকেই সমস্যায় রয়েছেন। তবে একটা সামান্য উপাদান দৈনন্দিন গ্রহণের ফলে আপনি আপনার ওজন কে নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারেন।
কাঁচা হলুদের মধ্যে থাকা উপাদান গুলো শরীরে বাড়তি মেদ জমতে দেয় না। এবং দেহের মেটাপলিজমের হাড় বাড়িয়ে দেয়। যার ফলে শরীরে বাড়তি মেদ জমার সম্ভাবনাকে কমিয়ে দেয়। হলুদের মধ্যে থাকা কার কিউমিন শরীরে ফ্যাট সংরক্ষণকারী কোষগুলি উৎপাদনে বাঁধা সৃষ্টি করে এবং বিপাকীয় প্রক্রিয়াকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে।
হৃদযন্ত্র কে সুরক্ষা প্রদান করে হলুদ
সারা বিশ্বব্যাপী প্রায় ৩১% মানুষ হৃদ রোগের কারণে মারা যায়। হলুদের মধ্যে থাকা কারকিউমিন হৃদরোগ প্রতিরোধ করেন।
গবেষণায় দেখা গিয়েছে উচ্চ রক্তচাপের কারণে হৃদরোগের মতো সমস্যা গুলিকে প্রতিরোধ করতে পারে হলুদ। এছাড়া দেহের মধ্যে থাকা খারাপ কোলেস্টরলের মাত্রাকে কম করতে সাহায্য করে হলো।
হজম ক্ষমতার উন্নতি করে হলুদ
গবেষণায় দেখা গিয়েছে যারা নিয়মিত কাঁচা হলুদ খান। তাদের ক্ষেত্রে হজমের সহায়ক পাচক রসের সমস্যা কমিয়ে দেয় হলুদ। সেই সঙ্গে গ্যাস, অম্বল এবং অ্যা সিলেটের মতো সমস্যাগুলিও কমতে থাকে।
এছাড়া হলুদ হজমে উন্নতি ঘটিয়ে প্রদাহ জনিত রোগ, লিভারের রোগ এবং ডায়রিয়া জনিত সমস্যার সমাধান করতে পারে হলুদ।
এছাড়া হলুদের মধ্যে থাকা উপাদানগুলি গ্যাস্ট্রিক আলসারের প্রভাব কম করতে পারে তাই হজম ক্ষমতার উন্নতি করতে চাইলে নিয়মিত কাঁচা হলুদ খাওয়া দরকার।
বাতের ব্যথা কমায় হলুদ
যেকোনো ধরনের ব্যথা কমাতে হলুদের ব্যবহার খুব গুরুত্বপূর্ণ। এক্ষেত্রে বাতের ব্যথা, হাঁটুর ব্যথা, যেকোনো ধরনের পেশী ব্যথাগুলোর ক্ষেত্রে কাঁচা হলুদের ব্যবহার করা হয়ে থাকে। হলুদের মধ্যে থাকা অ্যান্টিইমফ্লেমেটরি উপাদান গুলো শরীরের ভেতর থেকে ব্যথা নিরাময় সহায়ক করে
সর্দি কাশি নিরাময় করে হলুদ
বর্তমানে ঋতু পরিবর্তনের সময় একটি গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা হল সর্দি কাশি। ছোট থেকে বড় প্রায় সব ঘরেই এই সমস্যা লেগেই রয়েছে। কারো কারো আবার এলার্জির কারণে বা জ্বরের মতো সমস্যা হয়ে থাকে। এই সমস্যা থেকে সহজে মুক্তি পাওয়া যায় হলুদের সহায়তায়। হলুদ সর্দি-কাশি কমাতে সাহায্য করে।
এছাড়া কাঁচা হলুদ অনকর্মতা দূর করতে সাহায্য করে। কাঁচা হলুদে থাকা ভিটামিন সি সর্দি কাশির মতো সমস্যা গুলিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে।
প্রাকৃতিক জীবানু নাশক হিসেবে কাজ করে হলুদ
হলুদের মধ্যে থাকা অ্যান্টিব্যাকটেরিয়াল বৈশিষ্ট্যটি যেকোনো ধরনের ব্যাকটেরিয়াকে সহজে ধ্বংস করে দিতে পারে। তাই বিভিন্ন পেটের অসুখ কিংবা ত্বকের রোগের ক্ষেত্রে হলুদের ব্যবহার খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
খাবারের মাধ্যমে পেটে যদি কোনোভাবেই জীবাণু সংক্রমণ হয়। সেক্ষেত্রে কাঁচা হলুদ গুড় বা মধু দিয়ে খেলে ওই সমস্যার সমাধান করা সম্ভব হয়। নিয়মিত সকাল বেলা খালি পেটে কাঁচা হলুদ খাওয়া দরকার।
অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট বৃদ্ধি করে হলুদ
কাঁচা হলুদ শরীরে অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট এর উপাদান গুলি বৃদ্ধি করে যা শরীরকে অ্যানিমিয়ার হাত থেকে রক্ষা করে। মূলত মেয়েদের ক্ষেত্রে অ্যানিমিয়া হওয়ার প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। তাই মেয়েদের প্রতিদিন কাঁচা হলুদ খাওয়া প্রয়োজন।
মস্তিষ্কের ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়
কাঁচা হলুদ মস্তিষ্কের ক্ষমতা বৃদ্ধি করতে সাহায্য করে। বিশেষজ্ঞদের মতে, নিয়মিত কাঁচা হলুদ খেলে অ্যালঝাইমার্স, ডিমেনশিয়া-সহ মস্তিষ্কের বেশ কিছু সমস্যা কয়েক হাত দূরে চলে যায়।
বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে আমাদের মস্তিষ্কে যে সমস্যাগুলি দেখা দেয়, তা দূরে সরিয়ে রেখে ব্রেনকে আরও সজাগ করে তোলে কাঁচা হলুদ।
বয়সজনিত নানা রোগের প্রকোপ কমায়
আর্থারাইটিসের সমস্যা থাকলে কাঁচা হলুদ খান। উপকার পাবেন। শুধু তাই নয়, খালি পেটে নিয়মিত হলুদ খেলে অল্প বয়সে বুড়িয়ে যাওয়ার আশঙ্কাও কমে। বয়সজনিত নানা সমস্যা দূরে রাখতেও এই প্রকৃতিক উপাদানটি বিশেষ ভূমিকা নেয়। তাই রোজ খালি পেটে কাঁচা হলুদ খান আর দূরে রাখুন সব শারীরিক সমস্যা।
কাঁচা হলুদের অপকারিতা
কাঁচা হলুদের যেমন উপকারিতা রয়েছে এর কয়েকটি অপকারিতা রয়েছে চলুন জেনে আসা যাক এর অপকারিতা গুলো।
- শরীর থেকে আয়রণ শোষণ করে নেয় অতিরিক্ত হলুদ। তখন হিমোগ্লোবিনের মাত্রা কমে যায়। ফলে আয়রনের ঘাটতি তৈরি হয় শরীরে। হলুদের মধ্যে থাকা কিউকারমিন ভেঙে ফেরিক কিউকারমিন তৈরি হয়। যার জন্যেই অতিরিক্ত আয়রন শরীর থেকে শুষে ।
- এই যৌগটি দেহে আয়রন ভারসাম্যের জন্য দায়ী পেপটাইডস, হেপসিডিন সংশ্লেষণকেও বাধা দিতে পারে। এই সমস্ত কারণগুলো একসাথে আয়রনের ঘাটতি বাড়ে। শুধুমাত্র শরীরে আয়রনের ঘাটতি হতে পারে এমন নয় সেই সঙ্গে হজমেরও কিন্তু সমস্যা হতে পারে। খুব বেশি হলুদ খেলে ত্বকের সমস্যা, মাথা ধরা এসব লেগেই থাকে। এছাড়াও লিভার বড় হয়ে যাওয়া, আলসার, প্রদাহ এসবও হতে পারে।
- হলুদের মধ্যে যে কিউকারমিন থাকে তা কিন্তু আমাদের শরীরের জন্য খুবই ভালো। স্বাস্থ্যের দিক থেকেও উপকারী। কিন্তু বেশি হলুদ খেলে কিংবা হলুদের সাপ্লিমেন্ট খেলে শুধুই যে অ্যানিমিয়া হবে তা নয়। এর সঙ্গে রক্তপাতে সমস্যা, কিডনি স্টোন, ডায়াবেটিস এসবও কিন্তু আসতে পারে।
কাঁচা হলুদ খাওয়ার নিয়ম
সকালে ও রাতে দুই বেলায় ২৫০ মিলিগ্রাম করে হলুদ খাওয়া যেতে পারে। সকালে খালি পেটে হলুদ খাওয়ার পর আধ ঘণ্টা কিছু না খাওয়াই উচিত।
অন্যদিকে রাতে ঘুমোনোর আগে হলুদ-দুধ খেতে পারেন। তবে খেয়াল রাখবেন এর থেকে বেশি পরিমাণে হলুদ খাবেন না যেন, তাতে ক্ষতি হতে পারে।
কাঁচা হলুদ নিয়ে কিছু প্রচলিত প্রশ্ন
দিনে কতটা করে খেলে ফল মিলবে?
বিজ্ঞানীরা বলছেন, রোজ ২৫০ মিলিগ্রাম হলুদই যথেষ্ট। সকালে ও রাতে দুই বেলায় ২৫০ মিলিগ্রাম করে হলুদ খাওয়া যেতে পারে। সকালে খালি পেটে হলুদ খাওয়ার পর আধ ঘণ্টা কিছু না খাওয়াই উচিত। অন্যদিকে রাতে ঘুমোনোর আগে হলুদ-দুধ খেতে পারেন।
তবে খেয়াল রাখবেন এর থেকে বেশি পরিমাণে হলুদ খাবেন না যেন, তাতে ক্ষতি হতে পারে।
কাঁচা হলুদ খেলে কি ফর্সা হয়?
হলুদ স্বাস্থ্যের জন্য খুবই উপকারী, এটি শুধুমাত্র খাবারেই ব্যবহার করা হয় না, এটি ত্বকের জন্যও খুবই উপকারী।
অ্যান্টিব্যাকটেরিয়াল, অ্যান্টি-ফাঙ্গাল এবং অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট বৈশিষ্ট্যে সমৃদ্ধ, হলুদ মুখের ব্রণ এবং ব্রণর মতো ত্বক সম্পর্কিত আরও অনেক সমস্যা দূর করতে সাহায্য করে।
কাঁচা হলুদ আর মধু খেলে কি হয়?
কাঁচা হলুদের রস মধু মিশিয়ে খেলে লিভারের সমস্যায় উপকার পাওয়া যায়। কাঁচা হলুদের রস সামান্য নুন মিশিয়ে সকালবেলা খালি পেটে খেলে কৃমি সারে। সকালে খালি পেটে কাঁচা হলুদ খেলে হজমশক্তির উন্নতি হয়, শরীরের প্রতিরোধ ক্ষমতাও বাড়ে। তবে রোজের রান্নায় হলুদ বেটে রান্না করা একটু সময় সাপেক্ষ।