বিনা অপারেশনে হার্টের ছিদ্রের চিকিৎসা – ওপেন হার্ট সার্জারির বিকল্প
জন্মগতভাবে বা পরবর্তীতে হৃদপিণ্ডের দেয়ালে অস্বাভাবিক ছিদ্র সৃষ্টি হতে পারে। এ ধরণের ছিদ্রের কারণে রক্তের স্বাভাবিক প্রবাহ ব্যাহত হয়।
এর থেকে হার্ট ফেইলিউর সহ বিভিন্ন জটিলতা হতে পারে। প্রথাগতভাবে এই সমস্যার সমাধানে বুকে কেটে ওপেন হার্ট সার্জারিই প্রধান চিকিৎসা পদ্ধতি ছিল।
তবে আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞানের অগ্রগতির সাথে সাথে বিনা অপারেশনে হার্টের ছিদ্রের চিকিৎসাও সম্ভব হচ্ছে। এ সম্পর্কে আমরা এই নিবন্ধে আলোকপাত করব।
হৃৎপিণ্ডে কী ধরণের ছিদ্র হতে পারে
হৃৎপিণ্ডে চারটি কক্ষ থাকে: দুটি উপরে (অ্যাট্রিয়া) এবং দুটি নীচে (ভেন্ট্রিকল)। অ্যাট্রিয়া এবং ভেন্ট্রিকলের মধ্যে দেয়াল থাকে যা রক্ত প্রবাহকে নিয়ন্ত্রণ করে।
জন্মগত ত্রুটির কারণে এই দেয়ালগুলিতে ছিদ্র তৈরি হতে পারে, যা হৃৎপিণ্ডের সমস্যার কারণ হতে পারে।
হৃৎপিণ্ডে যে ধরণের ছিদ্র হতে পারে:
অ্যাট্রিয়াল সেপ্টাল ডিফেক্ট (ASD)
- অ্যাট্রিয়াল সেপ্টাল ডিফেক্ট হল হৃৎপিণ্ডের উপরের দুটি কক্ষ (বাঁয়া এবং ডান অ্যাট্রিয়া) এর মধ্যবর্তী দেয়ালে (অ্যাট্রিয়াল সেপ্টাম) ছিদ্র হওয়া।
- এই ছিদ্রের কারণে অক্সিজেনযুক্ত এবং অক্সিজেনহীন রক্ত মিশ্রিত হতে পারে, যা হৃৎপিণ্ডকে অতিরিক্ত কাজ করতে বাধ্য করে।
- ASD-এর লক্ষণগুলির মধ্যে ক্লান্তি, শ্বাসকষ্ট এবং বুকে দ্রুত হার্টের গতি অন্তর্ভুক্ত।
- ASD-এর চিকিৎসার মধ্যে ওষুধ, অ্যাঞ্জিওপ্লাস্টি বা অস্ত্রোপচার অন্তর্ভুক্ত।
ভেন্ট্রিকুলার সেপ্টাল ডিফেক্ট (VSD)
- ভেন্ট্রিকুলার সেপ্টাল ডিফেক্ট হল হৃৎপিণ্ডের নীচের দুটি কক্ষ (বাঁয়া এবং ডান ভেন্ট্রিকল) এর মধ্যবর্তী দেয়ালে (ভেন্ট্রিকুলার সেপ্টাম) ছিদ্র হওয়া।
- এই ছিদ্রের কারণে অক্সিজেনযুক্ত এবং অক্সিজেনহীন রক্ত মিশ্রিত হতে পারে, যা হৃৎপিণ্ডকে অতিরিক্ত কাজ করতে বাধ্য করে।
- VSD-এর লক্ষণগুলির মধ্যে ক্লান্তি, শ্বাসকষ্ট এবং বুকে দ্রুত হার্টের গতি অন্তর্ভুক্ত।
- VSD-এর চিকিৎসার মধ্যে ওষুধ, অ্যাঞ্জিওপ্লাস্টি বা অস্ত্রোপচার অন্তর্ভুক্ত।
পেটেন্ট ডাক্টাস আরটারিওসাস (PDA)
- এটি একটি জন্মগত রোগ যা শিশুদের হতে পারে।
- গর্ভাবস্থায়, ডাক্টাস আরটারিওসাস নামক একটি রক্তনালী ফুসফুস থেকে অক্সিজেনযুক্ত রক্ত হৃৎপিণ্ডে বহন করে।
- জন্মের পর, এই রক্তনালী বন্ধ হয়ে যায়।
- PDA-তে, ডাক্টাস আরটারিওসাস জন্মের পর বন্ধ হয় না, যার ফলে অক্সিজেনযুক্ত রক্ত ফুসফুসে ফিরে যায়।
- PDA-এর লক্ষণগুলির মধ্যে ক্লান্তি, শ্বাসকষ্ট এবং বুকে দ্রুত হার্টের গতি অন্তর্ভুক্ত।
- PDA-এর চিকিৎসার মধ্যে ওষুধ, অ্যাঞ্জিওপ্লাস্টি বা অস্ত্রোপচার অন্তর্ভুক্ত।
হার্টের ছিদ্রের লক্ষণ
এই ছিদ্রগুলির লক্ষণগুলি হালকা থেকে গুরুতর হতে পারে:
ASD এবং VSD-এর লক্ষণগুলি
- ক্লান্তি: শারীরিক পরিশ্রমের সময় বা এমনকি বিশ্রামের সময়ও ক্লান্তি অনুভব করা।
- শ্বাসকষ্ট: দ্রুত হাঁটা বা সিঁড়ি ভাঙ্গার সময় শ্বাসকষ্ট।
- বুকে দ্রুত হার্টের গতি: হৃৎস্পন্দন দ্রুত বা অনিয়মিত বোধ করা।
- বুকে ব্যথা: বুকে চাপ, ব্যথা বা টান অনুভব করা।
- ছানি: অজ্ঞান হয়ে যাওয়া বা চেতনা হারানো।
PDA-এর লক্ষণগুলি
- ক্লান্তি: শারীরিক পরিশ্রমের সময় বা এমনকি বিশ্রামের সময়ও ক্লান্তি অনুভব করা।
- শ্বাসকষ্ট: দ্রুত হাঁটা বা সিঁড়ি ভাঙ্গার সময় শ্বাসকষ্ট।
- বুকে দ্রুত হার্টের গতি: হৃৎস্পন্দন দ্রুত বা অনিয়মিত বোধ করা।
- বুকে ব্যথা: বুকে চাপ, ব্যথা বা টান অনুভব করা।
- শরীরে ‘উড়ন্ত’ অনুভূতি: হৃৎস্পন্দনের সাথে শরীরে কম্পন অনুভব করা।
লক্ষণগুলির তীব্রতা ছিদ্রের আকার এবং অবস্থানের উপর নির্ভর করে। কিছু লোকের কোনো লক্ষণই থাকে না, বিশেষ করে ছিদ্র ছোট হলে। অন্যদের ক্ষেত্রে, লক্ষণগুলি গুরুতর হতে পারে এবং জীবনের ঝুঁকি তৈরি করতে পারে।
যদি আপনার মনে হয় যে আপনার বা আপনার পরিচিত কারো হৃৎপিণ্ডে ছিদ্র থাকতে পারে, তাহলে একজন ডাক্তারের সাথে পরামর্শ করা গুরুত্বপূর্ণ। ডাক্তার শারীরিক পরীক্ষা এবং বিভিন্ন পরীক্ষার মাধ্যমে ছিদ্র নির্ণয় করতে পারেন।
হৃৎপিণ্ডের দেয়ালে অস্বাভাবিক ছিদ্রের সৃষ্টি হলে তাকে হার্টের ছিদ্র বলে। এই ছিদ্রের কারণে রক্তের স্বাভাবিক প্রবাহ ব্যাহত হয় এবং বিভিন্ন জটিলতা দেখা দিতে পারে।
হার্টের ছিদ্রের ফলে সম্ভাব্য জটিলতা
হৃৎপিণ্ডের দেয়ালে অস্বাভাবিক ছিদ্রের সৃষ্টি হলে তাকে হার্টের ছিদ্র বলে। এই ছিদ্রের কারণে রক্তের স্বাভাবিক প্রবাহ ব্যাহত হয় এবং দীর্ঘমেয়াদে বিভিন্ন জটিলতা দেখা দিতে পারে।
- হার্ট ফেলিওর: রক্ত সঞ্চালনে ত্রুটির জন্য হার্টকে অতিরিক্ত পরিশ্রম করতে হয়। দীর্ঘমেয়াদে, এটি হার্ট ফেলিওরের দিকে নিয়ে যেতে পারে, যেখানে হৃৎপিণ্ড রক্ত সরবরাহের চাহিদা পূরণ করতে ব্যর্থ হয়।
- ফুসফুসের উচ্চ রক্তচাপ: অক্সিজেনসমৃদ্ধ রক্ত ফুসফুসে অতিরিক্ত জমা হলে ফুসফুসের রক্তচাপ বেড়ে যায়। এটি ফুসফুসের ক্ষতি করতে পারে এবং শ্বাসকষ্টের সমস্যা তৈরি করতে পারে।
- স্ট্রোক: ছিদ্র দিয়ে রক্তের থ্রোম্বাস (clot) বেরিয়ে গিয়ে মস্তিষ্কে আঘাত করলে স্ট্রোক হতে পারে।
- এরিথমিয়া: হৃৎস্পন্দনের ছন্দ অনিয়মিত হয়ে যেতে পারে, যার ফলে দ্রুত হার্টস্পন্দন (tachycardia), ধীর হার্টস্পন্দন (bradycardia), বা অস্বাভাবিক হৃৎস্পন্দন (arrhythmia) দেখা দিতে পারে।
অন্যান্য জটিলতা
- সংক্রমণ: ছিদ্রের কারণে হৃৎপিণ্ডের সংক্রমণের ঝুঁকি বেড়ে যায়।
- অন্তঃহৃৎপিণ্ডের ছিদ্র (Endocardial cushion defect): এটি হৃৎপিণ্ডের ভেতরের টিস্যুর অস্বাভাবিক বৃদ্ধি।
- বৃদ্ধি ব্যাহত: শিশুদের ক্ষেত্রে, হার্টের ছিদ্রের কারণে শারীরিক বৃদ্ধি ব্যাহত হতে পারে।
জটিলতার ঝুঁকি নির্ভর করে
- ছিদ্রের আকার: বড় ছিদ্রে জটিলতার ঝুঁকি বেশি।
- ছিদ্রের ধরন: কিছু ধরণের ছিদ্র, যেমন অ্যাট্রিয়াল সেপ্টাল ডিফেক্ট (ASD), অন্যদের তুলনায় কম জটিলতা সৃষ্টি করে।
- বয়স: শিশুদের তুলনায় প্রাপ্তবয়স্কদের জটিলতার ঝুঁকি বেশি।
বিনা অপারেশনে চিকিৎসা (ক্যাথেটার বেসড)
প্রথাগত চিকিৎসা পদ্ধতিতে হার্টের ছিদ্র বন্ধ করার জন্য বুকের ভেতর দিয়ে অপারেশন বা ওপেন হার্ট সার্জারি করা হতো। কিন্তু আধুনিক চিকিৎসা পদ্ধতির একটি হলো ক্যাথেটারের মাধ্যমে চিকিৎসা দেয়া।
- কীভাবে করা হয়? এ পদ্ধতিতে রোগীর উরুতে অবস্থিত ধমনী দিয়ে একটি সরু নল ঢোকানো হয়। এই নলের ভিতর দিয়ে বিশেষ ধরণের ডিভাইস বসিয়ে হার্টের ছিদ্রটি বন্ধ করে দেয়া হয়। ক্যাথেটার পদ্ধতি অনেক কম আক্রমণাত্মক (less invasive) এবং অপারেশনের তুলনায় কম ঝুঁকিপূর্ণ।
- সব ক্ষেত্রে কি এই চিকিৎসা দেয়া যায়? সব ধরণের ছিদ্রের ক্ষেত্রে এই পদ্ধতি প্রয়োগ করা যায় না। ছিদ্রের অবস্থান, ধরণ ও আকার ইত্যাদি বিবেচনা করে ডাক্তার সিদ্ধান্ত নেন ক্যাথেটার পদ্ধতি সম্ভব কি না।
ক্যাথেটার বেসড পদ্ধতির সুবিধা
- কাটাছেঁড়া নেই, ক্ষত ছোট I
- হাসপাতালে কম সময় থাকতে হয় I
- দ্রুত আরোগ্য I
- বেশিরভাগ ক্ষেত্রে পরবর্তীতে কোনো ওষুধ লাগে না I
সীমাবদ্ধতা
- সব ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা যায় না।
- পরবর্তীতে ডিভাইসটি সরে গেলে পুনরায় অস্ত্রোপচার লাগতে পারে।
উপসংহার
হার্টে ছিদ্র থাকা স্বাস্থ্যের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। তাই ছিদ্রের উপস্থিতি নিশ্চিত হলে চিকিৎসার পরামর্শ নিতে হবে। অতীতের তুলনায় বর্তমানে হার্টের ছিদ্রের চিকিৎসার বিভিন্ন পদ্ধতি রয়েছে।
চিকিৎসক প্রতিটি রোগীর ক্ষেত্রে বিভিন্ন বিষয় বিবেচনা করে যথাযথ চিকিৎসা পদ্ধতি প্রয়োগ করেন।
গুরুত্বপূর্ণ: চিকিৎসা সংক্রান্ত যেকোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে অবশ্যই একজন চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।