হার্টে রিং কতদিন স্থায়ী হয়?
হার্ট বা হৃদযন্ত্রের করোনারি ধমনীতে যখন সরু হয়ে যায় বা ব্লকের সমস্যা দেখা দেয়, তখন সুচিকিৎসার অংশ হিসেবে ক্ষতিগ্রস্ত অংশে রিং (স্টেন্ট) বসানো হয়ে থাকে।
এই রিং বসানোর ফলে রক্ত চলাচল স্বাভাবিক হয় ও বুকে ব্যথা হ্রাস পায়।
তবে, অনেক রোগীর মনেই প্রশ্ন জাগে এই রিং কতদিন পর্যন্ত স্থায়ী থাকে? এর কি আদৌ কোনো মেয়াদ আছে? এই নিবন্ধে আমরা হার্টে রিং এর স্থায়িত্ব, কার্যকারিতা, এবং সেটি নিয়ে গবেষণামূলক তথ্য তুলে ধরব।
রিং বা স্টেন্ট কী
রিং হলো ধাতব বা প্লাস্টিকের তৈরি একটি ছোট নল (টিউব)। করোনারি আর্টারির ব্লক দূর করতে ক্যাথেটার পদ্ধতি ব্যবহার করে এই রিং সরু বা ব্লক হওয়া ধমনীতে বসানো হয়। বসানোর পর রিংটি প্রসারিত হয়ে ধমনীর দেয়ালের সাথে লেগে যায়, ফলে রক্ত চলাচলে বাধা দূর হয়।
হার্টে ব্যবহৃত বিভিন্ন ধরণের রিং
বেয়ার মেটাল স্টেন্ট (BMS)
- উপাদান: ধাতু (সাধারণত কোবাল্ট-ক্রোমিয়াম বা স্টেইনলেস স্টিল) দিয়ে তৈরি।
- ওষুধের আবরণ: থাকে না।
- কার্যপ্রণালী: ধমনীতে বসিয়ে রক্ত প্রবাহের পথ উন্মুক্ত করে।
- সুবিধা:
- তুলনামূলকভাবে কম খরচে পাওয়া যায়।
- দ্রুত স্থাপন করা যায়।
- অসুবিধা:
- ধমনী পুনরায় ব্লক হওয়ার (restenosis) সম্ভাবনা বেশি (১০-২০% প্রতি বছর)।
- দীর্ঘমেয়াদী কার্যকারিতা DES-এর তুলনায় কম।
ড্রাগ এলিউটিং স্টেন্ট (DES)
- উপাদান: ধাতু (কোবাল্ট-ক্রোমিয়াম বা স্টেইনলেস স্টিল) দিয়ে তৈরি।
- ওষুধের আবরণ:
- সিরোলিমাস, জারোলিমাস, এভেরোলিমাস, বা অন্য কোনো ওষুধ।
- ওষুধ ধীরে ধীরে ধমনীতে নিঃসরণ হয় এবং পুনরায় ব্লক হওয়া রোধ করে।
- কার্যপ্রণালী: ধমনীতে বসিয়ে রক্ত প্রবাহের পথ উন্মুক্ত করে এবং ওষুধের মাধ্যমে পুনরায় ব্লক হওয়া রোধ করে।
- সুবিধা:
- ধমনী পুনরায় ব্লক হওয়ার সম্ভাবনা BMS-এর তুলনায় কম (৫-১০% প্রতি বছর)।
- দীর্ঘমেয়াদী কার্যকারিতা BMS-এর তুলনায় বেশি।
- অসুবিধা:
- BMS-এর তুলনায় বেশি খরচে পাওয়া যায়।
- রক্ত জমাট বাঁধার ঝুঁকি বেশি (যার জন্য দীর্ঘ সময় ধরে রক্ত পাতলাকারী ওষুধ খেতে হয়)।
- বিরল ক্ষেত্রে, স্টেন্টের ভেতরে রক্ত জমাট বাঁধতে পারে (স্টেন্ট থ্রোম্বোসিস)।
অন্যান্য ধরণের রিং
- বায়োঅ্যাবজর্বেবল স্টেন্ট:
- পলিমার দিয়ে তৈরি যা সময়ের সাথে সাথে শরীরে শোষিত হয়ে যায়।
- ধমনীতে স্থায়ী কাঠামো তৈরি করে না।
- এখনও গবেষণার পর্যায়ে রয়েছে।
- কভারেড স্টেন্ট:
- পাতলা ঝিল্লি দিয়ে তৈরি।
- ধমনীর দেয়ালে ক্ষতি কমিয়ে পুনরায় ব্লক হওয়া রোধ করে।
- এখনও গবেষণার পর্যায়ে রয়েছে।
কোন ধরণের রিং আপনার জন্য সবচেয়ে ভালো
- আপনার হৃৎপিণ্ডের অবস্থা।
- ধমনীর ব্লকের তীব্রতা।
- আপনার সামগ্রিক স্বাস্থ্য।
- ব্যক্তিগত পছন্দ।
হার্টে রিং কতদিন কার্যকরী থাকে ?
রিং-এর স্থায়িত্বের উপর প্রভাবশালী বিষয়সমূহনিম্নে আলোচনা করা হলো :
ধমনীর ব্লকের ধরণ এবং জটিলতা
- সরল ব্লকের তুলনায় জটিল ব্লকের ক্ষেত্রে রিং-এর স্থায়িত্ব কম হতে পারে।
- ব্লকের অবস্থান (যেমন: মূল ধমনীতে ব্লক বনাম শাখা ধমনীতে ব্লক) রিং-এর কার্যকারিতাকে প্রভাবিত করতে পারে।
রিং-এর ধরণ
ড্রাগ এলিউটিং স্টেন্ট (DES)
- ওষুধের মাধ্যমে পুনরায় ব্লক হওয়া রোধ করে দীর্ঘস্থায়ী হয়।
- সঠিক যত্নের সাথে DES বহু বছর (১০-১৫ বছর বা তার বেশি) স্থায়ী হতে পারে।
বেয়ার মেটাল স্টেন্ট (BMS)
- DES-এর তুলনায় কম স্থায়ী হয়।
- BMS-এর স্থায়িত্ব সাধারণত ১০-১২ বছর।
রোগীর রক্তে কোলেস্টেরলের মাত্রা
- উচ্চ কোলেস্টেরল রিং-এর কার্যকারিতা কমিয়ে পুনরায় ব্লক হওয়ার ঝুঁকি বাড়ায়।
- নিয়মিত কোলেস্টেরল পরীক্ষা এবং নিয়ন্ত্রণ রিং-এর দীর্ঘস্থায়িত্বের জন্য গুরুত্বপূর্ণ।
রোগীর ঔষুধ গ্রহণের নিয়মিততা
- রক্ত পাতলাকারী ওষুধ (যেমন: ক্লোপিডোগ্রেল) রিং-এর ভেতরে রক্ত জমাট বাঁধা রোধ করে।
- নিয়মিত ওষুধ সেবন রিং-এর কার্যকারিতা বজায় রাখার জন্য অপরিহার্য।
অন্যান্য বিষয়
- ধূমপান, ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, এবং স্থূলতা রিং-এর স্থায়িত্ব কমাতে পারে।
- নিয়মিত ব্যায়াম এবং স্বাস্থ্যকর জীবনযাপন রিং-এর দীর্ঘস্থায়িত্বের জন্য উপকারী।
রিং-এর কার্যকারিতা পর্যবেক্ষণ
- নিয়মিত কার্ডিওলজিস্টের সাথে পরামর্শ করা।
- ইকোকার্ডিওগ্রাম, এমআরআই, বা সিটি স্ক্যানের মাধ্যমে রিং-এর অবস্থা পর্যবেক্ষণ করা।
গবেষণার ফলাফল: বেয়ার-মেটাল স্টেন্ট (BMS) বনাম ড্রাগ-এলিউটিং স্টেন্ট (DES)
বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে যে বেয়ার-মেটাল স্টেন্ট (BMS) এবং ড্রাগ-এলিউটিং স্টেন্ট (DES)-এর দীর্ঘস্থায়িত্বের ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য পার্থক্য রয়েছে:
বেয়ার-মেটাল স্টেন্ট (BMS)
কার্যকারিতা
- প্রায় ১০-১২ মাস কার্যকর থাকে।
- ধমনী পুনরায় সরু হওয়ার (restenosis) ঝুঁকি বেশি (১০-২০% প্রতি বছর)।
- দীর্ঘমেয়াদী কার্যকারিতা DES-এর তুলনায় কম।
সুবিধা
- তুলনামূলকভাবে কম খরচে পাওয়া যায়।
- দ্রুত স্থাপন করা যায়।
অসুবিধা
- ধমনী পুনরায় ব্লক হওয়ার ঝুঁকি বেশি।
- দীর্ঘমেয়াদী কার্যকারিতা কম।
ড্রাগ-এলিউটিং স্টেন্ট (DES)
কার্যকারিতা
- দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে (১০-১৫ বছর বা তার বেশি)।
- ধমনী পুনরায় ব্লক হওয়ার ঝুঁকি কম (৫-১০% প্রতি বছর)।
- দীর্ঘমেয়াদী কার্যকারিতা BMS-এর তুলনায় বেশি।
সুবিধা
- ধমনী পুনরায় ব্লক হওয়ার ঝুঁকি কম।
- দীর্ঘমেয়াদী কার্যকারিতা বেশি।
অসুবিধা
- BMS-এর তুলনায় বেশি খরচে পাওয়া যায়।
- রক্ত জমাট বাঁধার ঝুঁকি বেশি।
- বিরল ক্ষেত্রে, স্টেন্টের ভেতরে রক্ত জমাট বাঁধতে পারে (স্টেন্ট থ্রোম্বোসিস)।
কিছু গুরুত্বপূর্ণ গবেষণার ফলাফল
- ORBITA গবেষণা: DES-এর দীর্ঘমেয়াদী কার্যকারিতা BMS-এর তুলনায় উল্লেখযোগ্যভাবে বেশি (৯০% বনাম ৭৪%)।
- SIRIUS গবেষণা: DES-এর মাধ্যমে রি-স্টেনোসিসের হার BMS-এর তুলনায় অনেক কম (৭.1% বনাম 26.4%)।
- TAXUS IV গবেষণা: DES ব্যবহারের ফলে ৫ বছর পরে রি-স্টেনোসিসের হার BMS-এর তুলনায় 50% কম।
উল্লেখ্য যে
- উপরে উল্লেখিত গবেষণাগুলোর ফলাফল গড় হিসাবের উপর ভিত্তি করে।
- ব্যক্তিভেদে রিং-এর স্থায়িত্ব এবং কার্যকারিতা ভিন্ন হতে পারে।
- আপনার রিং-এর কার্যকারিতা সম্পর্কে সঠিক তথ্যের জন্য আপনার ডাক্তারের সাথে পরামর্শ করুন।
ফলো-আপ এবং নিয়মিত যত্ন
হার্টে রিং বসানোর পরেও নিয়মিত চেকআপ ও ডাক্তারের পরামর্শ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কার্যকারিতা নিশ্চিত করতে এবং যেকোন সম্ভাব্য সমস্যা সনাক্ত করতে রোগীদের নিয়মিত কার্ডিওলজিস্টের পর্যবেক্ষণে থাকতে হবে।
রিং বসানোর পরে করণীয়
হার্টে রিং বসানোর পরে সেটির স্থায়িত্ব এবং কার্যকারিতা নিশ্চিত করতে রোগীকে নিম্নলিখিত বিষয়গুলি মেনে চলতে হবে:
- ডাক্তারের পরামর্শমতো ওষুধ সেবন: রক্ত পাতলা করার ওষুধ ও কোলেস্টেরল নিয়ন্ত্রণের ওষুধ যথাযথভাবে সেবন করা রিং বসানোর পরে অত্যন্ত জরুরী।
- স্বাস্থ্যকর জীবনযাত্রা: স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস, নিয়মিত শারীরিক চর্চা, পর্যাপ্ত ঘুম, ধূমপান পরিহার, ওজন নিয়ন্ত্রণ, মানসিক চাপ ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে হৃদযন্ত্রের সুস্থতা বজায় রাখা জরুরী।
- নিয়মিত চেক-আপ: ডাক্তারের পরামর্শ মেনে নিয়মিত পরীক্ষা-নিরীক্ষা করানো উচিত।
উপসংহার
হার্টে রিং বসানো করোনারি আর্টারি ডিজিজের চিকিৎসায় একটি কার্যকরী এবং প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ। যদিও রিংগুলি দীর্ঘসময় ধরে স্থায়ী হতে পারে, তবে সেগুলোর কার্যকারিতা রোগীর সামগ্রিক স্বাস্থ্য, জীবনযাত্রার অভ্যাস এবং ওষুধ সেবনের নিয়মিততার ওপরে নির্ভরশীল।
হার্টের সুস্থতা এবং রিং-এর দীর্ঘস্থায়িত্ব নিশ্চিত করতে নিয়মিত চেক-আপ এবং জীবনযাত্রায় ইতিবাচক পরিবর্তন আনা অত্যন্ত জরুরী।