গ্রীন টির উপকারিতা, অপকারিতা এবং সাবধানতা
গ্রীন টি একটি চমৎকার স্বাস্থ্যকর এবং উপকারী পানীয়। এটি ক্যামেলিয়া সিনেনসিস পাতা এবং কুঁড়ি অর্থাৎ চা গাছের পাতা এবং কুঁড়ি থেকে তৈরি করা হয়। এর স্বাস্থ্য উপকারিতা অন্যান্য চা অপেক্ষা অনেক বেশি। যারা স্বাস্থ্য সচেতন তারা ডিটক্স পানীয় হিসেবে নিয়মিত এটি পান করে থাকেন। ওজন কমানোর ক্ষেত্রে গ্রীন টি এর জুড়ি নেই।
এই চা এর মূল উৎপত্তিস্থল চীন হলেও বর্তমানে এর উৎপাদন এশিয়ার অনেক দেশে ছড়িয়ে পড়েছে। বাংলাদেশের সিলেটের এর চাষ করা হয়। আমাদের দেশের গ্রীন টি এর জনপ্রিয়তা দিনকে দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। আপনাদের সুস্বাস্থ্যের কথা চিন্তা করে খাস ফুড সরবরাহ করছে শতভাগ বিশুদ্ধ এবং নিরাপদ অর্গানিক গ্রীন টি।
গ্রীন চায়ের পুষ্টিগুণ তালিকা (Green Tea )
নিচের তালিকাটি ২৪০ মিলিগ্রাম (এক কাপ) সেদ্ধ করা গ্রীন চায়ের পুষ্টিগুণের পরিমাণ এবং একটি গড় প্রাপ্তবয়স্কের দৈনিক খাদ্যের প্রয়োজনীয়তা অনুযায়ী ডেইলি ভ্যালু (DV) এর শতাংশ প্রদর্শন করে। এছাড়াও গ্রীন চाय সম্পর্কে কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দেওয়া হলো:
পুষ্টি উপাদান | প্রতি কাপ (২৪০ মিলি) সেদ্ধ গ্রীন চায়ে | ডেইলি ভ্যালু (DV) শতাংশ* | অন্যান্য |
---|---|---|---|
ক্যালোরি | ২ | <১% | |
মোট চর্বি | ০ গ্রাম | ০% | |
সোডিয়াম | ২ মিলিগ্রাম | <১% | |
মোট কার্বোহাইড্রেট | ০ গ্রাম | ০% | |
ডায়েটারি ফাইবার | ০ গ্রাম | ০% | |
চিনি | ০ গ্রাম | – | |
প্রোটিন | ০ গ্রাম | ০% | |
ক্যাফিন | ২৫-৩০ মিলিগ্রাম | – | চায়ের ধরণ, ফোটানোর সময়ের উপর নির্ভর করে পরিবর্তিত হয় |
ক্যাটেচিন (অ্যান্টিঅক্সিডेंट) | ~১০০-২০০ মিলিগ্রাম | – | শক্তিশালী অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট, নির্দিষ্ট পরিমাণ পরিবর্তিত হয় |
ডিভি (DV) গণনা করা হয়েছে ২,০০০ ক্যালোরি খাদ্যের উপর ভিত্তি করে।
অতিরিক্ত তথ্য
- প্রধান উপকারিতা: গ্রীন চায়ের মূল্যায়ন আসে এর উচ্চ মাত্রার অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট, বিশেষত ইজিসিজি, থেকে।
- সম্ভাব্য স্বাস্থ্য উপকারিতা (গবেষণা চলছে):
- বিপাক বাড়াতে পারে
- মস্তিষ্কের কার্যকারিতা উন্নত করতে পারে
- নির্দিষ্ট কিছু ক্যান্সারের বিরুদ্ধে রক্ষা করতে পারে
- রক্তে শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করতে পারে
- গুরুত্বপূর্ণ বিষয়সমূহ:
- ক্যাফিন সংবেদনশীলতা: কিছু মানুষের ঘাবড়াহট বা ঘুমের সমস্যা হতে পারে।
- নির্দিষ্ট কিছু ওষুধের সাথে মিথষ্ক্রিয়া করতে পারে, চিন্তা থাকলে আপনার ডাক্তারের সাথে পরামর্শ করুন।
টিপস:
- ফোটানো: পানির তাপমাত্রা এবং ফোটানোর সময় অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট এবং ক্যাফিনের ঘনত্বকে প্রভাবিত করে।
- গুণমান: উচ্চতর গুণমানের জন্য পাতার চা বাছাই করুন।
গ্রিন টি’র উপকারিতা
ভিন্ন গবেষণায় দেখা গিয়েছে যে নিয়মিত গ্রিন টি পান বার্ধক্যের ছাপকে ঘুচিয়ে ত্বক এর জৌলুস ফিরিয়ে আনে এবং ক্যান্সার এর ঝুঁকি কমায়।
এছাড়াও এতে রয়েছে আরো অসংখ্য গুনাগুণ। এমন উপকারী গুণগুলোর জন্য এখন বিখ্যাত বিউটি ব্র্যান্ডগুলো তাদের পণ্যে উপাদান সংযোজন করছে। চলুন জেনে নেওয়া যাক রূপচর্চা ও সুস্বাস্থ্যে এর উপকারিতা।
- বর্তমানে গ্রিন টি সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয় এর ওজন কমানোর গুণের কারণে। এটি অতিরিক্ত চর্বি কমিয়ে ওজন নিয়ন্ত্রণে আনতে সাহায্য করে। একটি গবেষণায় দেখা গিয়েছে যে এটি এক দিনে ৭০ ক্যালরি পর্যন্ত ফ্যাট বার্ন করে। তার মানে রেগুলার গ্রিন টি পানের মাধ্যমে বছরে ৭ পাউন্ড পর্যন্ত ওজন কমানো সম্ভব।
- খুব ভালো টোনার হিসেবে কাজ করে। এটি তৈরির জন্য ১ কাপ পানিতে ৫ চা চামচ গ্রিন টি, ১ চা চমচ পুদিনা পাতা ১০ মিনিট ফুটান। তারপর ঠান্ডা করে ছেঁকে নিয়ে একটি স্প্রে বোতলে সংরক্ষণ করুন। এই টোনারটি দিনে ২-৩ বার ব্যবহার করুন। এটি ত্বকের চুলকানি ও প্রদাহ দূর করতে খুব উপকারী।
- এতে রয়েছে এক ধরনের এন্টিঅক্সিডেন্ট যা বার্ধক্যের গতিকে ধীর করে এবং আয়ু বাড়ায়।
- চোখের ফোলা ভাব এবং চোখের নিচের ডার্ক সার্কেল কমাতে ব্যবহার করা গ্রিন টির দুটি ব্যাগ ২ ঘন্টা ফ্রিজ এ রেখে, ঠান্ডা করে চোখ বন্ধ করে এর উপর ১০ মিনিট রাখুন।
- ড্রাই গ্রিন টির পাতা মধুর সাথে মিক্স করে স্ক্রাব হিসেবে ব্যবহার করা যায় যা লোমকুপের ময়লা এবং মৃত কোষ দূর করে ত্বককে নরম ও মসৃণ করে।
- ঘামের দুর্গন্ধ দূর করতে গ্রিন টি ডিওডোরেন্ট হিসেবে ভালো কাজ করে। গোসলের পর ঠান্ডা গ্রিন টি আন্ডারআর্ম এ লাগালে দুর্গন্ধ দূর হবে। ঠিক এমনিভাবে পায়ের দুর্গন্ধ দূর করতেও একই পদ্ধতি অনুসরণ করলে ভালো ফল পাওয়া যায়।
- অর্ধেক কলা, ১ চা চামচ গ্রিন টি, ১ চা চামচ মধু এবং ১ চা চামচ টক দই ভালো মতো মিশিয়ে মুখে লাগান এবং শুকালে ধুয়ে ফেলুন। এটি শুষ্ক ত্বকের জন্য খুব ভালো ময়েশ্চারাইজিং মাস্ক হিসেবে কাজ করে।
- নিয়মিত এক কাপ গ্রিন টি পান হার্ট এর রোগের ঝুঁকি ৪৪% কমিয়ে দেয় এবং ব্লাড প্রেসারনিয়ন্ত্রণে থাকে।
- মশা মাছির উপদ্রব থেকে বাঁচতে শুকনো চা পাতা ঘরের কোনায় রেখে পোড়ালে মশা মাছি কমবে।
- এটি নিয়মিত পান মুখের দুর্গন্ধ দূর করে, ওরাল ব্যাকটেরিয়া ধ্বংস করে এবং ডেন্টাল ক্যাভিটিস প্রতিরোধ করে।
- ৩-৪ টি গ্রিন টি ব্যাগ ১ লিটার পানিতে এক ঘণ্টা ফুটিয়ে ঠান্ডা করে নিন। এরপর চুল শ্যাম্পু এবং কন্ডিশনিং করার পর সেই পানি দিয়ে চুল ধুয়ে ফেলুন। এটি আপনার চুলকে শক্ত ও মজবুত করবে। চুল পড়া কমাতেও আপনি ব্যবহার করতে পারেন গ্রিন টি। এটি চুলের গোড়া শক্ত করে এবং হেয়ার ফলিকল উদ্দীপিত করে যা নতুন চুল গজাতে সহায়ক।
- ফ্রিজের দুর্গন্ধ দূর করতে এর শুকনো পাতা একটি পাতলা কাপড়ে বেঁধে ফ্রিজের এক কোনায় রেখে দিন।
- মেডিকেল গবেষণায় দেখা গিয়েছে যে, গ্রিন টি ব্রণের সমস্যা ট্রিটমেন্টের জন্য খুবই কার্যকরী। এটি ত্বকে কোন রকম ইরিটেশন বা ড্রাইনেস তৈরী করা ছাড়াই ব্রণ নির্মূল করে।
- গ্রিন টি মাউথওয়াশ হিসেবে খুব ভালো কাজ করে। এতে আছে এন্টিব্যাক্টেরিয়াল প্রপার্টিস ফলে এতে কোনো এলকোহল নেই যা রেগুলার মাউথওয়াশে থাকতে পারে।
- সবুজ চা পাতা পানিতে কয়েকদিন ভিজিয়ে রেখে গাছের গোড়ায় সেই পানি দিলে তা ফারটিলাইজার হিসেবে কাজ করে।
এই উপায়ে গ্রিন টি খাবেন না
কিছু কিছু উপায়ে গ্রিন টি খাওয়ার শরীরের জন্য একদমই ভালো নয় চলুন জেনে আসা যাক সেই উপায় গুলো
- খাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে গ্রিন টি খাবেন না। অনেকে মনে করেন, খাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে গ্রিন টি খেলে খাবারের অতিরিক্ত ক্যালরি গ্রিন টি শোষণ করে নেবে। কিন্তু আদতে খাবারে যে প্রোটিন থাকে, তা হজমের আগেই গ্রিন টি খেলে হজমপ্রক্রিয়ায় ব্যাঘাত ঘটতে পারে।
- খুব গরম অবস্থায় গ্রিন টি খাবেন না। তাতে আপনার ঠোঁট, জিহ্বা বা পাকস্থলীর ক্ষতি হতে পারে। সেরা ফল পেতে আট থেকে দশ মিনিট অপেক্ষা করে গ্রিন টি খানI
- গ্রিন টি যেহেতু ‘ডিটক্স’, অনেকে মনে করেন, সকালে খালি পেটে গ্রিন টি খাওয়া উচিত। কিন্তু একেবারে খালি পেটে খাওয়ার চেয়ে হালকা কিছু খেয়ে শরীরের মেটাবলিজম সিস্টেম চালু করে তারপর গ্রিন টি খেলে ভালো ফল দেবে, নতুবা অ্যাসিডিটির সমস্যা হতে পারে। সবচেয়ে ভালো হলো দুবার খাবারের মাঝামাঝি খাওয়া।
- অনেকে গ্রিন টির সঙ্গে মধু মিশিয়ে খান। কেননা, চিনি অস্বাস্থ্যকর। ‘সাইলেন্ট হোয়াইট পয়জন’। তবে গরম অবস্থায় মধু মেশালে এর কার্যকারিতা অনেকটাই কমে যায়। তাই একান্তই মধু মেশালে পান করার আগে উষ্ণ গরম অবস্থায় গ্রিন টিতে মধু মেশাবেন।
- গ্রিন টির সঙ্গে ওষুধ খাবেন না। কেননা, বিভিন্ন ওষুধের উপাদান গ্রিন টির সঙ্গে মিশে জটিল উপাদান তৈরি করে। তাতে ওষুধের কার্যকারিতা কমে যেতে পারে।
- গ্রিন টি স্বাস্থ্যকর। তাই বলে আপনি যত খুশি তত গ্রিন টি খেতে পারেন না। চা বা কফির মতো গ্রিন টিতেও ক্যাফেইন থাকে। আর অতিরিক্ত ক্যাফেইন গ্রহণে অনিদ্রা, মাথাব্যথা, উদ্বেগ, আলসেমি—এগুলো চেপে বসতে পারে। আয়রন শোষণের পরিমাণও কমিয়ে দেয় ক্যাফেইন। দিনে দুই থেকে তিন কাপ গ্রিন টি খেতে পারেন।
- বাজারে এখন নানা ফ্লেভারের গ্রিন টি পাওয়া যায়। তবে ‘ন্যাচারাল ফ্লেভার’ গ্রিন টি খাওয়াই সবচেয়ে ভালো।
- একটা গ্রিন টির কাপে দুটি টি-ব্যাগ মেশাবেন না। এতে অ্যাসিডিটির আশঙ্কা বাড়বে, হজমেও গোলযোগ হতে পারে।
- সকালে উঠেই খালি পেটে, দুপুর ১২টায়, সন্ধ্যায় খাবার খাওয়ার এক ঘণ্টা পর বা রাতে ঘুমাতে যাওয়ার ঠিক আগে গ্রিন টি খাবেন না। সম্ভব হলে দুবার ভারী খাবারের মাঝখানে গ্রিন টি খাবেন।
- গ্রিন টির সঙ্গে গুঁড়া দুধ, চিনি বা অন্য কোনো মসলা, লেবু কিছুই মেশাবেন না।
গ্রীন টি অপকারিতা
প্রতিটি প্রিয়ারে বিপরীত প্রতিক্রিয়া রয়েছে ঠিক তেমনি প্রতিটি খাবারের উপকারিতার সাথে এর অপকারিতা রয়েছে।
- আপনি যখন একেবারে খালি পেটে গ্রিন টি খাবেন তখন এতে থাকা ট্যানিন উপাদান আপনার পাকস্থলীর অ্যাসিডিটি বাড়িয়ে তুলবে। যে কারণে দেখা দেবে পেট ব্যথা। সেইসঙ্গে বাড়বে কোষ্ঠকাঠিন্য। পেটে সৃষ্ট অতিরিক্ত অ্যাসিডের কারণে দেখা দিতে পারে বমিভাব বা বমির মতো সমস্যাও।
- যাদের আগে থেকেই পেপটিক আলসার বা অ্যাসিড রিফ্লাক্সের সমস্যা রয়েছে তাদের সকালে গ্রিন টি না পান করার পরামর্শ দেওয়া হয়। এর কারণ হলো, সকালে খালি পেটে গ্রিন টি খেলে তাদের সমস্যা আরও বেড়ে যেতে পারে।
- আমাদের সুস্থ থাকার জন্য শরীরে পর্যাপ্ত আয়রন পৌঁছানো জরুরি। কিন্তু আপনি যদি খালে পেটে গ্রিন টি খান তবে তা আয়রন শোষণের ক্ষমতা কমিয়ে দেয়। যে কারণে শরীরে নানা সমস্যা দেখা দিতে পারে। বিশেষ করে যারা রক্তশূন্যতায় ভুগছেন তাদের গ্রিন টি থেকে দূরে থাকাই ভালো।
- রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখতে চাইলে খালি পেটে গ্রিন টি খাবেন না। কারণ খালি পেটে গ্রিন টি খেলে বেড়ে যেতে পারে রক্তচাপ। এই চায়ে থাকা ক্যাফেইন অ্যাড্রিনাল গ্রন্থিগুলোকে উদ্দীপিত করে। যা অ্যাড্রেনালিন এবং কর্টিসলের মতো স্ট্রেস হরমোন রিলিজ করে। যে কারণে বেড়ে যায় হৃদস্পন্দন ও রক্তচাপ। এটি হৃদরোগে আক্রান্তদের জন্য ক্ষতিকর।
সকালে গ্রিন টি খাওয়া যাবে?
সকালে গ্রিন টি খাওয়া যাবে তবে খালি পেটে নয়। খেতে হবে অন্য কোনো হালকা খাবারের সঙ্গে। হতে পারে তা মুড়ি, টোস্ট কিংবা বিস্কুট। কিন্তু কোনো খাবার না খেলে শুরুতেই যদি গ্রিন টি খান, তখন পড়তে হতে পারে সমস্যায়।
গ্রিন টি খাওয়ার সময়
খাবার খাওয়ার ঠিক পরেই যদি গ্রিন টি খাওয়া হয় তাহলে তা উল্টে ক্ষতি হতে পারে। খালি পেটে গ্রিন টি খাবেন না। কারণ বিশেষজ্ঞদের মতে, গ্রিন টি খেতে হলে দুটি ভারী খাবারের মাঝখানের বিরতিতেই খাওয়া উচিত। সবচেয়ে বেশি উপকার পেতে হলে কোনও ভারী খাবার খাওয়ার ২ ঘণ্টা আগে কিংবা ২ ঘণ্টা পরে গ্রিন টি খেতে পারেন।
গ্রীন টি বানানোর নিয়ম
জল গরম করে ফুটে গেলে ৮০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় জল থাকলে ভাল। তারপর তা সামান্য ঠান্ডা হলে স্টিল বা কাচের পাত্রে রাখতে হবে। তার পর এতে চা পাতা যোগ করে ৩ মিনিট ঢাকা দিয়ে রাখতে হবে। চা পাতা পুরোপুরি ভিজে গেলে পছন্দের কাপে চা ছেঁকে চুমুক দিন প্রিয় পানীয়তে।