পেঁয়াজ খাবার উপকারিতা, অপকারিতা এবং সংরক্ষণের উপায়
পেঁয়াজ আমাদের রান্নাঘরে সবসময় মজুত থাকে। দেশের একটি অংশের মানুষ একে আমিষ বলে মানলেও, অপর অংশ কিন্তু এই খাবারকে নিরামিষ মনে করে। তবে সে সব কথা আজ নয় অন্যদিন হবে। বরং আজ শুধু পেঁয়াজের গুণ নিয়ে আলোচনা করা যাক।
আমাদের মধ্যে অনেকেই কাঁচা পেঁয়াজ খেতে পছন্দ করেন। এনারা মুড়ি থেকে ভাত, সবের সঙ্গেই একটা কাঁচা পেঁয়াজ মুখে তোলেন।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, স্বাদের তাগিদে খাবারটি খেলেও, অজান্তেই তাঁরা শরীরের উপকারই করছেন। কারণ পেঁয়াজ খেলে বহু অসুখ থেকে দূরে থাকা যায়।
পেঁয়াজের পুষ্টিগুণ
পেঁয়াজে আছে ভিটামিন বি১ থায়ামিন, বি২ রিবোফ্লাবিন, বি৩ নিয়াসিন, বি৫ প্যান্টোথেনিক অ্যাসিড, বি৬, বি৯ ফোলেট ও ভিটামিন সি।
পেঁয়াজ শরীরে শক্তি জোগায়, বিভিন্ন ভিটামিনের গুণ দিয়ে দেহকে সাবলীল রাখতে কাজ করে, হার্টের কার্যক্ষমতা ও কার্ডিভাসকুলার ফাংশন ঠিকঠাক রাখতে সাহায্য করে।
পেঁয়াজের পুষ্টিকর উপাদান এবং দৈনিক চাহিদা পূরণের হার
পুষ্টি উপাদান | প্রতি ১০০ গ্রাম পেঁয়াজে পরিমাণ | দৈনিক চাহিদার শতকরা হার* |
---|---|---|
ডায়েটারি ফাইবার | ১.৭ গ্রাম | ৭% |
ভিটামিন সি | ৭.৪ মিলিগ্রাম | ১২% |
ম্যাঙ্গানিজ | ০.১২৯ মিলিগ্রাম | ৬% |
ভিটামিন বি৬ | ০.১২ মিলিগ্রাম | ৬% |
পটাশিয়াম | ১৪৬ মিলিগ্রাম | ৪% |
দৈনিক চাহিদার শতকরা হার একজন প্রাপ্তবয়স্কের গড় প্রয়োজনের উপর ভিত্তি করে তৈরি করা হয়েছে।

পেঁয়াজের গুরুত্ব
- অ্যান্টিঅক্সিডেন্টের উৎস: পেঁয়াজে রয়েছে কুয়ারসেটিন সহ বিভিন্ন অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট যা আমাদের কোষকে ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা করে।
- অ্যান্টি-ইনফ্লেমেটরি বৈশিষ্ট্য: পেঁয়াজের অ্যান্টি-ইনফ্লেমেটরি বৈশিষ্ট্য দেহের প্রদাহ কমাতে সাহায্য করতে পারে।
- প্রিবায়োটিকসের উৎস: পেঁয়াজে প্রিবায়োটিকস রয়েছে যা অন্ত্রের স্বাস্থ্যকর ব্যাকটেরিয়ার বৃদ্ধিকে উদ্দীপিত করে।
- রোগ প্রতিরোধের ক্ষমতা বৃদ্ধি: পেঁয়াজে থাকা ভিটামিন সি আমাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা শক্তিশালী করে।
বিশেষ দ্রষ্টব্য
- পেঁয়াজ একটি স্বাদবর্ধক খাবার হিসেবে বেশি ব্যবহৃত হয়। একসাথে প্রচুর পরিমাণে পেঁয়াজ খাওয়া হয় না।
- পেঁয়াজের পুষ্টির পরিমাণ তুলনামূলকভাবে অন্যান্য সবজির চেয়ে কম থাকে।
পেঁয়াজের উপকারিতা
জানলে অবাক হবেন, পেঁয়াজের বেশ কিছু খাদ্যগুণ রয়েছে। এর স্বাস্থ্য সংক্রান্ত উপকারিতা জানলে হয়তো আপনিও মেনুতে পেঁয়াজ যোগ করবেন।
পুষ্টির ভাণ্ডার
হেলথলাইন জানাচ্ছে, পুষ্টির ভাণ্ডার রয়েছে পেঁয়াজে। এতে আছে ভিটামিন সি, ভিটামিন বি, ফোলেট, বি৬-এর মতো জরুরি ভিটামিন। এছাড়া এই খাবারে রয়েছে পটাশিয়াম। এই খনিজ কিন্তু শরীরের বিভিন্ন কাজে প্রয়োজন পড়ে।
ব্লাডপ্রেশার নিয়ন্ত্রণ থেকে শুরু করে নার্ভ ট্রান্সমিশন, কিডনি ফাংশনের জন্য পটাশিয়াম জরুরি। এছাড়া পেঁয়াজে ক্যালোরি থাকে খুবই কম। ফলে এই খাবারটি মুখে তুলে ওজন বাড়বে না এক ফোঁটা। অতিরিক্ত ওজনের কারণে যাঁরা চিন্তায় রয়েছেন তাঁরাও নিশ্চিন্তে পেঁয়াজ খেতে পারেন।
হার্ট সুস্থ রাখে
হার্টের অসুখে আক্রান্তের সংখ্যা এখন হু হু করে বৃদ্ধি পাচ্ছে। অনেকেই এই রোগে প্রাণ পর্যন্ত হারাচ্ছেন। তাই এই হৃদরোগ এড়ানোর পথ জানতে হবে।
বিভিন্ন গবেষণায় জানা যাচ্ছে যে পেঁয়াজে এমন কিছু উপাদান রয়েছে যা কোলেস্টেরল কমিয়ে দিতে পারে। এই কারণে হার্টের অসুখে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা হ্রাস পায়। আসলে পেঁয়াজে রয়েছে কুয়ারসেটিন নামক একটি উপাদান। এই উপাদান প্রদাহ দূর করে। ফলে হার্টের রোগ দূরে থাকে।
ক্যানসার প্রতিরোধে সক্ষম
ক্যানসার অসুখটির কথা শুনলেই মন কেমন কেমন করে। এই অসুখে আক্রান্ত হলে সমস্যার শেষ থাকে না। রোগীর পাশাপাশি তাঁর পরিবারকেও নানা জটিলতার মধ্যে দিয়ে যেতে হয়। এই রোগের চিকিৎসার খরচ অনেক।
ফলে বহু ক্ষেত্রে সঠিক চিকিৎসাই করা সম্ভব হয় না। তাই ক্যানসার প্রতিরোধের বিষয়ে জোর দিতে বলেন চিকিৎসকরা। গবেষণা জানাচ্ছে, নিয়মিত পেঁয়াজ খেলে অনায়াসে ক্যানসার প্রতিরোধ করা যায়। বিশেষত, পাকস্থলী, কোলোন ক্যানসার থেকে রক্ষা পাওয়া যায়।
ব্লাড সুগার থাকে নিয়ন্ত্রণে
ডায়াবিটিস একটি ঘাতক অসুখ। এই রোগে আক্রান্ত হলে সমস্যার শেষ থাকে না। একটু অনিয়ম করলেই সুগার বেড়ে কিডনি, চোখ, স্নায়ু, হার্টের উপর কুপ্রভাব পড়ে।
তাই ব্লাড সুগার নিয়ন্ত্রণে রাখার চেষ্টা করুন। বিভিন্ন গবেষণাজনিত ফলাফলে উঠে এসেছে যে, ব্লাড সুগার নিয়ন্ত্রণে রাখার ক্ষেত্রে দারুণ কার্যকরী হতে পারে পেঁয়াজ। বিশেষত যাঁদের প্রিডায়াবিটিস রয়েছে তাঁরা পেঁয়াজ খেয়ে রোগকে আটকে রাখতে পারেন।
সংক্রমণ সারায়
পেঁয়াজের মধ্যে কার্মিনেটিভ, অ্যান্টিমাইক্রোবায়াল, অ্যান্টিসেপ্টিক এবং অ্যান্টিবায়োটিক জাতীয় পদার্থ রয়েছে। তাই শরীরে কোথাও সংক্রমণ হয়ে থাকলে কাঁচা পেঁয়াজ খেতে পারেন।
এতে ভালো উপকার মিলবে। এছাড়া পেঁয়াজের রসের সঙ্গে মধু মিশিয়ে খেলে সর্দি, কাশির সমস্যা থাকে না। ঠান্ডা লাগার ফলে গলা ব্যথা, সর্দি-কাশি, জ্বর, অ্যালার্জি বা সামান্য গা ব্যথায় দারুণ কাজ করে।
দাঁতের সংক্রমণ রোধ: দাঁতের সংক্রমণ রোধ করতেও পেঁয়াজ বেশ উপকারি। পেঁয়াজ চিবিয়ে খেলে দাঁতের ফাঁকে লুকিয়ে থাকা জীবাণুগুলো মরে যায়।সেই সঙ্গে সংক্রমণের সম্ভাবনাও কমে যায়।
চুল পড়া হ্রাস করে
চুল পড়া কমানো ও চুল বৃদ্ধিতে পেঁয়াজ খুবই উপকারি। পেঁয়াজের মধ্যে প্রচুর সালফার রয়েছে, যা চুল পড়া রোধ করে। বিশেষ করে চুল ভেঙে যাওয়া রোধ করে এবং প্রাকৃতিকভাবে চুলের বৃদ্ধিতে সাহায্য করে।
হাড়ের শক্তি বৃদ্ধি করে
হাড়ের শক্তি নিয়ে কথা উঠলেই বেশিরভাগই ভিটামিন ডি এবং ক্যালশিয়ামের কথা বলবেন। তবে এই দুই উপাদান বাদেও হাড়ের স্বাস্থ্যের উন্নতির জন্য আরও কিছু জিনিস প্রয়োজন হয়।
দেখা গিয়েছে যে, মহিলাদের ক্ষেত্রে হাড়ের সমস্যা সমাধান করতে পারে পেঁয়াজ। এক্ষেত্রে মেনোপজের পরবর্তী সময়ে হাড়ের ক্ষয়জনিত সমস্যা দূর করে হয়। তাই হাড় সুস্থ-সবল রাখতেও পেঁয়াজ খান।
রক্ত চলাচল নিয়ন্ত্রণ রাখে
নিয়মিত পেঁয়াজ খেলে রক্ত চলাচল ঠিক থাকে। যার ফলে হার্টের অসুখের সম্ভাবনাও অনেকটা কমে যায়।
সংক্রমণ
সারায়পেঁয়াজের মধ্যে কার্মিনেটিভ, অ্যান্টিমাইক্রোবায়াল, অ্যান্টিসেপ্টিক এবং অ্যান্টিবায়োটিক জাতীয় পদার্থ রয়েছে। তাই শরীরে কোথাও সংক্রমণ হয়ে থাকলে কাঁচা পেঁয়াজ খেতে পারেন।
এতে ভালো উপকার মিলবে। এছাড়া পেঁয়াজের রসের সঙ্গে মধু মিশিয়ে খেলে সর্দি, কাশির সমস্যা থাকে না। ঠান্ডা লাগার ফলে গলা ব্যথা, সর্দি-কাশি, জ্বর, অ্যালার্জি বা সামান্য গা ব্যথায় দারুণ কাজ করে।

পেঁয়াজের অপকারিতা
প্রতিটি জিনিসের উপকারিতার পাশাপাশি অপকারিতাও থাকে। যেমন অতিরিক্ত পরিমাণে কাঁচা পেঁয়াজ ও কিন্তু শরীরের জন্য ভালো না।
অনেক ধরনের সমস্যা তৈরি করতে পারে।
- পেঁয়াজে প্রচুর পরিমাণে গ্লুকোজ এবং ফ্রুক্টোজ থাকে। এ ছাড়া এতে ফাইবারের পরিমাণও বেশি থাকে, যা কেউ কেউ ভালোভাবে হজম করতে পারে না। এমন অবস্থায় অ্যাসিডিটির সমস্যা হতে পারে।
- যদি কোনো কারণে পেট সংক্রান্ত সমস্যা থেকে যায় তাহলে পেঁয়াজ খাওয়া এড়িয়ে চলুন। কাঁচা পেঁয়াজের কারণে হজমের সমস্যা আরও বাড়তে পারে।
- অতিরিক্ত কাঁচা পেঁয়াজ খেলে মুখে দুর্গন্ধ হয়। তাও কাঁচা পেঁয়াজ পরিমিত পরিমাণে খেলেও খাওয়ার পর পর পানি দিয়ে মুখ ধুয়ে ফেলতে হবে।
- প্রচুর পরিমাণে কাঁচা পেঁয়াজ খেলে অনেক সময় বুকে জ্বালাপোড়া হতে পারে। এতে অম্বলের সমস্যা তৈরি হতে পারে।

পেঁয়াজ খাওয়ার নিয়ম
কাঁচা নয়, পেঁয়াজ কুচি সামান্য মাখনে ভেজে মধু দিয়ে প্রতিদিন সকালে খেতে পারলে মিলন ক্ষমতা প্রায় তিন গুণ পর্যন্ত বৃদ্ধি পেতে পারে। তাই এমন সমস্যায় ভুগলে এভাবে পেঁয়াজ খাওয়ার অভ্যাস করুন।
একাধিক গবষণায় এই বিষয়টি প্রমাণিত হয়েছে। গবেষকরা জানাচ্ছেন, পেঁয়াজের রস টেস্টোস্টেরন হরমনের ক্ষরণ বেশ খানিকটা বাড়িয়ে দেয়।
দিনে কতটুকু পেঁয়াজ খাওয়া যাবে
আপনার চর্বি এবং শর্করা গ্রহণ সীমিত করার পাশাপাশি, পেঁয়াজ খাওয়া আপনার রক্তে শর্করা এবং আপনার ওজন সঠিক পথে পেতে পারে।
তাই এখানে একটি সহজ, শক্তিশালী স্বাস্থ্য-বর্ধক সুপারিশ: প্রতিদিন একটি পেঁয়াজ খান। একটি মাঝারি আকারের পেঁয়াজ কাটার সময় প্রায় এক কাপ পেঁয়াজের সমান ।
পেঁয়াজ এত মিষ্টি কেন
প্রাথমিক ফ্যাক্টর যা পেঁয়াজের মিষ্টতা নির্ধারণ করে তা হল জিনগত, পাইরুভিক অ্যাসিড স্তরের সাথে সম্পর্কিত । স্টোরেজ পেঁয়াজে পাইরুভিক অ্যাসিডের পরিমাণ 10-13% পর্যন্ত থাকে, যখন মিষ্টি পেঁয়াজে এটি 5% এর নিচে থাকে।
অন্যান্য কারণ যা তীক্ষ্ণতার মাত্রাকে প্রভাবিত করতে পারে তা হল ক্রমবর্ধমান অবস্থা।
পেঁয়াজ সংরক্ষণ নিয়ম
পিঁয়াজ বাড়িতে বেশ কিছুদিন সংরক্ষণ করে রাখতে চাইলে সেটিও সম্ভব চলুন দেখে আসা যাক কিভাবে আপনি বাড়িতে সহজেই পেঁয়াজ সংরক্ষণ করতে পারবেন।
- শুকনো জায়াগায় রাখুন: পেঁয়াজ সংরক্ষণের জন্য ঠান্ডা ও শুষ্ক জায়গা বেছে নেওয়াই শ্রেয়। তবে অন্ধকার নয়, আলো-বাতাস চলাচল করে, এমন জায়গায় ছড়িয়ে রাখতে হবে পেঁয়াজ। বাজার থেকে পেঁয়াজ কিনে আনার পর প্লাস্টিকের প্যাকেটে পুরে রেখে দেবেন না। খবরের কাগজ বা পাটের বস্তায় রাখলে পেঁয়াজ দীর্ঘ দিন ভাল থাকবে। এ ছাড়াও ঝুড়ি, বাঁশের পাত্রে সংরক্ষণ করতে পারেন।
- ফ্রিজেও রাখতে পারেন: পেঁয়াজ দীর্ঘ দিন ভাল রাখতে ফ্রিজে রাখুন। কিন্তু ফ্রিজের অন্যান্য খাবারে গন্ধ হয়ে যাওয়ার ভয়ে অনেকেই ফ্রিজে পেঁয়াজ রাখতে চান না। অনেকের ফ্রিজেই আলাদা জায়গা থাকে পেঁয়াজ রাখার জন্য। সেখানে রাখতে পারেন। ভুলেও অন্য শাক-সব্জির সঙ্গে পেঁয়াজ রাখবেন না। বড় জিপলক পাউচে ভরেও পেঁয়াজ রাখতে পারেন।
- বেরেস্তা করে রাখুন: যদি দেখে মনে হয় পেঁয়াজে পচন ধরতে শুরু করেছে, তা হলে সবের আগে সেই পেঁয়াজগুলি আলাদা করে নিন। তার পর খোসা ছাড়িয়ে খারাপ অংশটুকু ফেলে বাকিটা লম্বা লম্বা কুচি করে কেটে নিন। এ বার ডুবো তেলে লাল করে ভেজে টিস্যু পেপারে তুলে রাখুন। তেল শুকিয়ে গেলে একটি পাত্রে ভরে ঠান্ডা করে নিন। ভেজে রাখা বেরেস্তা ফ্রিজে তুলে রাখুন। রান্নায় বেরেস্তা ব্যবহার করলে স্বাদ বেড়ে যায় কয়েক গুণ।