কিডনিতে পানি জমলে করণীয়
কিডনি আমাদের দেহের একটি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ। রক্ত পরিশোধন থেকে হরমোন নিঃসরণ পর্যন্ত নানা গুরুত্বপূর্ণ কাজ করে কিডনি।
আমাদের শরীরের তরলের ভারসাম্য রক্ষা করা কিডনির অন্যতম প্রধান কাজ। কিন্তু নানা কারণে কিডনি সঠভাাবে কাজ করতে না পারলে সেখানে অতিরিক্ত তরল জমা হতে পারে।
কিডনির সাথে সাথে শরীরের অন্য অংশে, যেমন পা বা মুখেও পানি জমতে দেখা যায়। চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভাষায় এই অবস্থাকে ‘এডিমা’ বলে। কিডনিতে পানি জমা একটি গুরুতর শারীরিক সমস্যা যা দ্রুত চিকিৎসা না করালে মারাত্মক আকার ধারণ করতে পারে।
কিডনিতে পানি জমার কারণ
কিডনিতে পানি জমার বিভিন্ন কারণ থাকতে পারে। কিছু সাধারণ কারণগুলো হলো:
- নেফ্রোটিক সিনড্রোম: কিডনির ক্ষুদ্র ফিল্টারিং ইউনিটের (নেফ্রোন) ক্ষতি হলে এই সমস্যা হয়। ফলে প্রোটিন প্রস্রাবের সাথে বেরিয়ে যেতে থাকে, যার ফলে রক্তে প্রোটিনের মাত্রা কমে যায়। প্রোটিনের অভাব শরীরে তরলের ভারসাম্যহীনতা তৈরি করে এবং কিডনিতে পানি জমতে থাকে।
- নেফ্রাইটিস: কিডনির প্রদাহকে নেফ্রাইটিস বলা হয়। এই রোগে কিডনি ঠিকভাবে রক্ত পরিশোধন করতে পারে না বলে শরীরে তরল আধিক্য দেখা দেয়।
- কিডনি ফেইলিউর: কিডনি তার কার্যকারিতা সম্পূর্ণভাবে হারিয়ে ফেললে পানি, লবণ এবং বর্জ্য পদার্থ শরীর থেকে বেরিয়ে যেতে পারে না। ফলে শরীরের বিভিন্ন অংশে, বিশেষ করে কিডনিতে তরল জমে যায়।
- হার্ট ফেইলিউর এবং লিভারের সমস্যা: হার্ট দুর্বল হয়ে গেলে বা লিভার রোগ যেমন সিরোসিস হলে রক্তনালীতে চাপ বেড়ে যায়। তখন কিডনি বেশি তরল এবং লবণ ধরেে রাখে ফলে শরীরে পানি জমে।
কিডনিতে পানি জমার লক্ষণসমূহ
কিডনিতে পানি জমলে যে লক্ষণগুলি দেখা দিতে পারে তা হলো –
- পায়ে ফোলা ভাব
- তলপেট বা মুখে ফুলে যাওয়া
- শ্বাসকষ্ট
- দ্রুত ওজন বৃদ্ধি
- ক্ষুধামন্দা
- বমি বমি ভাব বা বমি
- উচ্চ রক্তচাপ
কিডনিতে পানি জমার চিকিৎসা: বিস্তারিত আলোচনা
কিডনিতে পানি জমার চিকিৎসা নির্ভর করে এর মূল কারণের উপর।
চিকিৎসার কিছু সাধারণ পদ্ধতি:
ডায়ুরেটিকস
- ডায়ুরেটিকস বা ‘পানি বের করার ওষুধ’ শরীর থেকে অতিরিক্ত পানি বের করে দেওয়ার জন্য ব্যবহার করা হয়।
- এই ওষুধগুলি কিডনিকে পানি এবং লবণ বের করে দেওয়ার জন্য উদ্দীপিত করে।
- ডায়ুরেটিকস ব্যবহারের ফলে প্রস্রাবের পরিমাণ বৃদ্ধি পায় এবং শরীরের ফোলাভাব কমে যায়।
- তবে, ডায়ুরেটিকস দীর্ঘ সময় ধরে ব্যবহার করলে কিছু পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা দিতে পারে।
লবণ ও তরল গ্রহণ কমানো
- অধিকাংশ ক্ষেত্রেই কিডনি রোগের চিকিৎসায় লবণের আহার কমিয়ে দিতে হয়।
- লবণ শরীরে পানি ধরে রাখতে সাহায্য করে। তাই লবণের পরিমাণ কমালে শরীরে জমা অতিরিক্ত পানি বের হয়ে যায়।
- এছাড়াও পানি ও তরল পদার্থ গ্রহণের উপরও নিয়ন্ত্রণ আনানা যেতে পারে।
- তবে, তরল পানি কমিয়ে দেওয়ার ব্যাপারে ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়া উচিত।
রক্তচাপের ওষুধ
- উচ্চ রক্তচাপ কিডনির উপর চাপ সৃষ্টি করে এবং পরিস্থিতি কঠিন করতে পারে।
- তাই উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখা কিডনিতে পানি জমা রোধে গুরুত্বপূর্ণ।
- রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণের জন্য ডাক্তার রক্তচাপের ওষুধ লিখে দিতে পারেন।
অন্যান্য চিকিৎসা
- যে সমস্ত রোগের কারণে কিডনিতে পানি জমছে, সেই রোগগুলির সঠিক চিকিৎসা করা দরকার।
- উদাহরণস্বরূপ, ডায়াবেটিস, হৃদরোগ, লিভারের রোগ ইত্যাদি রোগের সঠিক চিকিৎসা কিডনিতে পানি জমা রোধে সাহায্য করবে।
কিছু বিশেষ টিপস
- নিয়মিত ডাক্তারের সাথে যোগাযোগ রাখা: কিডনিতে পানি জমা রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিদের নিয়মিত ডাক্তারের সাথে যোগাযোগ রাখা উচিত।
- ওষুধ নিয়মিত সেবন করা: ডাক্তার যে ওষুধ লিখে দিয়েছেন তা নিয়মিত সেবন করা উচিত।
- খাদ্যাভ্যাসে পরিবর্তন আনা: লবণ ও চর্বিযুক্ত খাবার কম খাওয়া উচিত।
- নিয়মিত ব্যায়াম করা: নিয়মিত ব্যায়াম শরীরের রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখতে এবং ওজন কমাতে সাহায্য করে, যা কিডনির জন্য উপকারী।
মনে রাখবেন, কিডনিতে পানি জমা একটি গুরুতর রোগ। তাই দ্রুত ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়া এবং সঠিক চিকিৎসা গ্রহণ করা অপরিহার্যI
কিডনি ফেইলিউর এবং ডায়ালিসিস
কিছু কিছু ক্ষেত্রে, কিডনিতে পানি জমা কিডনি ফেইলিউরের কারণ হতে পারে। কিডনি যখন স্বাভাবিকভাবে কাজ করতে পারে না, শরীরে অতিরিক্ত পানি, লবণ এবং বর্জ্য পদার্থ জমতে থাকে। এই অবস্থায় ডায়ালিসিসের প্রয়োজন হতে পারে।
- ডায়ালিসিস হলো একটি কৃত্রিম উপায়ে শরীর থেকে বর্জ্য পদার্থ এবং অতিরিক্ত পানি অপসরণ করার প্রক্রিয়া।
- ডায়ালিসিস দুই ধরনের হতে পারেI
- হেমোডায়ালিসিস: এই প্রক্রিয়ায় রক্তকে একটি মেশিনের মাধ্যমে পরিশোধন করা হয় এবং দেহে পুনরায় প্রবেশ করানো হয়।
- পেরিটোনিয়াল ডায়ালিসিস: এই প্রক্রিয়ায় পেটের গহ্বরে একধরনের তরল প্রবেশ করানো হয়, যা বর্জ্য পদার্থ শোষণ করে নেয়। পরে এই তরল পেট থেকে বের করে ফেলা হয়।
কিডনি ট্রান্সপ্লান্ট
কিছু কিডনি রোগের ক্ষেত্রে কিডনি ফেইলিউর হলে কিডনি ট্রান্সপ্লান্ট করে নতুন কিডনি সংযোজন করার প্রয়োজন হতে পারে। তবে একজন ব্যক্তি একটি কিডনি নিয়েও স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে পারেন।
- কিডনি ট্রান্সপ্লান্ট করার আগে রোগীর সামগ্রিক স্বাস্থ্য পরীক্ষা করা হয়।
- কিডনি দাতা হলেন রোগীর কোনো নিকট আত্মীয় অথবা অন্য কোন জীবিত বা মৃত ব্যক্তি (শর্তসাপেক্ষে)।
- কিডনি ট্রান্সপ্লান্ট একটি জটিল সার্জারি এবং সার্জারির পরে সারাজীবন ওষুধ সেবন করতে হয়।
গুরুত্বপূর্ণ বিষয়
- কিডনিতে পানি জমার চিকিৎসা অনেকাংশে নির্ভর করে এর কারণের উপর।
- তাই এই শারীরিক সমস্যা দেখা দিলে দ্রুত ডাক্তারের শরণাপন্ন হওয়া উচিত।
- ডাক্তার রোগ নির্ণয় করে সঠিক চিকিৎসা এবং জীবনযাত্রায় প্রয়োজনীয় পরিবর্তন সম্পর্কে পরামর্শ দেবেন।
আপনার কোনো নির্দিষ্ট প্রশ্ন বা এই সমস্যা সম্পর্কে আরও জানার ইচ্ছা থাকলে দয়া করে জানান। আমি যথাসাধ্য সাহায্য করার চেষ্টা করবো।
কিডনিতে পানি জমা প্রতিরোধের উপায়
সুস্থ খাদ্যাভ্যাস
- ফল, শাকসবজি এবং পূর্ণ শস্য: প্রচুর পরিমাণে ফল, শাকসবজি এবং পূর্ণ শস্য খাওয়া কিডনির সুস্থতা বজায় রাখতে সাহায্য করে। এগুলোতে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন, খনিজ এবং ফাইবার থাকে যা শরীরের সামগ্রিক স্বাস্থ্যের জন্যও ভালো।
- প্রোটিন: প্রোটিন সমৃদ্ধ খাবার যেমন মাছ, মুরগির মাংস, ডিম, ডাল এবং বাদাম কিডনির জন্য উপকারী। তবে, কিডনি রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিদের প্রোটিন গ্রহণের পরিমাণ সীমিত করতে হতে পারে।
- চর্বি: অস্বাস্থ্যকর চর্বি, যেমন স্যাচুরেটেড এবং ট্রান্স ফ্যাট, কিডনির ক্ষতি করতে পারে। তাই অস্বাস্থ্যকর চর্বিযুক্ত খাবার যেমন লাল মাংস, প্রক্রিয়াজাত খাবার এবং ভাজা খাবার এড়িয়ে চলা উচিত।
- লবণ: অতিরিক্ত লবণ শরীরে পানি ধরে রাখতে পারে এবং কিডনির উপর চাপ সৃষ্টি করতে পারে। তাই লবণ গ্রহণের পরিমাণ কমিয়ে দেওয়া উচিত।
- পানি: প্রচুর পরিমাণে পানি পান করা কিডনিকে সঠিকভাবে কাজ করতে সাহায্য করে। প্রতিদিন কমপক্ষে ৮-১০ গ্লাস পানি পান করার চেষ্টা করুন।
লবণের আহার কমানো
- লবণ গ্রহণের পরিমাণ কমানো কিডনিতে পানি জমা রোধ করার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উপায়।
- প্রতিদিন লবণ গ্রহণের পরিমাণ ৫ গ্রামের (১ চা চামচ) কম রাখার চেষ্টা করুন।
- প্রক্রিয়াজাত খাবার, ফাস্ট ফুড এবং डिब्बाबंद খাবার এড়িয়ে চলুন কারণ এগুলোতে প্রচুর পরিমাণে লবণ থাকে।
- খাবার রান্নার সময় লবণের পরিবর্তে মশলা ব্যবহার করুন।
নিয়মিত ব্যায়াম
- নিয়মিত ব্যায়াম শরীরের রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখতে এবং ওজন কমাতে সাহায্য করে, যা কিডনির জন্য উপকারী।
- প্রতিদিন কমপক্ষে ৩০ মিনিট ব্যায়াম করার চেষ্টা করুন।
- হাঁটা, দৌড়ানো, সাঁতার কাটা, সাইকেল চালানো ইত্যাদি অ্যারোবিক ব্যায়াম কিডনির জন্য ভালো।
ধূমপান পরিহার
- ধূমপান রক্তচাপ বাড়ায় এবং কিডনির ক্ষতি করতে পারে।
- তাই ধূমপান ত্যাগ করা কিডনির সুস্থতা রক্ষার জন্য গুরুত্বপূর্ণ।
অ্যালকোহল পরিহার
- অ্যালকোহল রক্তচাপ বাড়ায় এবং কিডনির ক্ষতি করতে পারে।
- তাই অ্যালকোহল পান করা এড়িয়ে চলা উচিত।
ডায়াবেেটিস ও উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখা
- পারে। তাই এই রোগগুলোর সঠিক চিকিৎসা এবং নিয়ন্ত্রণ রাখা কিডনি রক্ষার জন্যে অপরিহার্য।
- রক্তে গ্লুকোজ এবং রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখতে নিয়মিত ডাক্তারের পরামর্শ নিন এবং ওষুধ সেবন করুন।
- সুস্থ খাদ্যাভ্যাস এবং নিয়মিত ব্যায়াম রক্তের গ্লুকোজ এবং রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে।
অতিরিক্ত ওষুধ সেবন থেকে বিরত থাকা
- কিডনির অন্যতম কাজ হলো শরীর থেকে ওষুধের বিপাকীয় পদার্থ বের করে দেওয়া। তাই অতিরিক্ত ওষুধ সেবন কিডনির উপর চাপ সৃষ্টি করে এবং ক্ষতি করতে পারে।
- ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়া প্রয়োজনহীন ওষুধ সেবন পরিহার করুন, বিশেষ করে পেইন কিলার বা ব্যথার ওষুধ।
কিডনির সমস্যা হলে দ্রুত চিকিৎসা করা
- কিডনির প্রদাহ, ইনফেকশন, কিংবা ক্যান্সারের মতো সমস্যা দ্রুত চিকিৎসা না করলে তা কিডনির ওপর চাপ সৃষ্টি করেরে এবং পানি জমার সমস্যাাকে বাড়িয়েত তুলতে পারে। তাই যেকোনো ধরনের কিডনি সমস্যাার উপসর্গ দেখা দিল দ্রুত ডাক্তারের শরণণাপন্ন হন।
কিডনিতে পানি জমা কেন্দ্রিক কিছু বিষেষ টিপস
- নিয়মিত ওজন মাপা: রোজ নিজ ওজনের ওপর নজর রাখুন। ওজনে আচমকা বৃদ্ধি কিডনিতে পানি জমার লক্ষণ হতেে পারারে।
- পায়ে ফুলে গেল কিনা খেয়াল করা: পা ফুলে গেলে কিডনিতে পানি জমার একটি উপ্রধান লক্ষণ।
- শরীরের পানি বের হওয়ার পরিমাণের দিকে লক্ষ্য রাখা: প্রস্রাবের পরিমাণ ক্মে গেলে এবং রঙগাঢল হয়ে গেলে কিডনির সমস্যাার দিকে ইঙ্গিত করতে পারে।
মনে রাখবেন, সবসময় কিডনিতে পানি জমা প্রতিরোধ সম্ভব নয়। বিশেশেত রোগের ক্ষেত্রে যেটি কিডনির করার্যকারিতাকে ব্যাহত করছেে। তবেে তবুও ওপরে উল্লেখিত স্বাস্থ্যকর অভ্যাসগুলি মেনে চললে কিডনি সুস্থ রাখা এবং এর জটিল সমস্যাগুলির ঝুঁকি কমানো যায়।
উপসংহার
কিডনিতে পানি জমা একটি গুরুতর সমস্যা। এর উপসর্গ দেখা দিলে দেরি না করে ডাক্তারের সাথে যোগাযোগ করা উচিত। সঠিকভাবে কারণ নির্ণয় করে চিকিৎসা এবং জীবনযাত্রায় প্রয়োজনীয় পিরবর্তন আনানা কিডনিকে সুস্থ রাখতে সাহায্য করবে।