থানকুনি পাতার উপকারিতা, অপকারিতা এবং ব্যবহারের নিয়ম
গ্রামে-গঞ্জে গত কয়েক বছর আগেও এই পাতার খুব কদর ছিল। কিন্তু যত দিন গিয়েছে মানুষ ভুলতে বসেছে এই পাতার উপকারিতা। এমনকী অনেকে চেনেও না এই পাতা
আজ থেকে কয়েক বছর আগেও গ্রামের সব বাড়িতেই থাকত থানকুনি পাতার গাছ। পরবর্তীতে শহরতলির বেশ কিছু বাড়িতেও লাগানো হত এই গাছ।
কারোর হাত কিংবা পা কেটে গেলে বা পেটের কোনও সমস্যা হলেই খোঁজ পড়ত থানকুনি পাতার। কোনও একটা ঘর থেকে নিশ্চিত পাওয়া যেতই। এমনকী প্রাচীন আর্য়ুবেদ শাস্ত্রেও এই পাতার প্রচুর গুণাগুণ বর্ণিত রয়েছে।
অনেক ওষুধও তৈরি হত এই পাতার রস থেকে। কিন্তু এখন এই পাতার দেখা আর প্রায় পাওয়াই যায় না। এমনকী এই প্রজন্মের ছেলে-মেয়েরা থানকুনি পাতা চেনেও না। কিন্তু শরীরকে নানা দিক দিয়ে সুস্থ রাখতে এই পাতার জুড়ি মেলা ভার।
প্রতিদিন এই পাতার রস খেতে পারলে অন্যরকম কোনও চিন্তা থাকবেই না। তবে শুধু আমাদের দেশেই নয়,খ্রিস্টপূর্ব ১৭ শতক থেকেই আফ্রিকা, জাভা, সুমাত্রাতেও ওষুধ হিসেবে ব্যবহার করা হয় এই পাতা।
থানকুনি পাতার উপকারিতা
থানকুনি পাতা খাওয়ার বেশ কয়েকটি উপকারিতা রয়েছে চলুন জেনে আসা যাক এর উপকারিতা গুলো।
ক্ষত নিরাময়ে
খেলতে গিয়ে কোনও ভাবে চোট পেলে কিংবা যদি হাত কেটে যায়, দ্রুত রক্তপাত বন্ধ করতে থানকুনি পাতার কোনও জুড়ি নেই।
থানকুনি পাতা বেটে কাটা জায়গায় লাগালে ব্যথা কম হবে আর রক্ত পড়াও বন্ধ হয়ে যাবে। এমনকী ক্ষত থেকে সংক্রমণের আশঙ্কাও থাকে না।
শরীরে রক্ত প্রবাহ ঠিক থাকে
অনেকের থ্রম্বোসিসের সমস্যা থাকে। এছাড়াও অনেকের দেহেই অন্যান্য শারীরিক সমস্যার কারণে রক্তপ্রবাহে সমস্যা হয়। থানকুনি পাতার রস খেলে রক্ত শুদ্ধ থাকে।
ফলে শরীরের প্রতি কোশে অক্সিজেন সমৃদ্ধ রক্ত পৌঁছে যায়। ফলে অনেক সমস্যার উপশম হয়। হাত ফুলে যাওয়া, পা ফুলে যাওয়া এসব থেকে মুক্তি পাওয়া যায়।
রক্ত জমাট বেঁধে যায় না
থানকুনি পাতার মধ্যে থাকে নানা রকম খনিজ উপাদান, যা তাড়াতাড়ি রক্ত জমাট বাঁধতে সাহায্য করে। যে কারণে অনেক জটিল রোগ থেকে খুব দ্রুত উপকার পাওয়া যায়।
শরীরে রক্ত জমাট বাঁধতে দেওয়া একদম উচিত নয়। কারণ এর ফলে হার্ট, কিডনি ও মস্তিষ্কের ক্ষতি হয়। অন্য অঙ্গও কাজ করা বন্ধ করে দিতে পারে। তাই এই বিষয়টি অবশ্যই খেয়াল করে রাখবেন।
শরীরের ভেতরের জ্বালা কমায়
কোনও কারণে শরীরের ভেতরে কোনও ক্ষত হলে নানা রকম সমস্যা হয়। জ্বর, ক্লান্তি এসব আসতেই পারে। এর সঙ্গে শরীরের অন্যান্য অঙ্গেরও ক্ষতি হয়ে যেতে পারে। এমনকী খিদে কমে যাওয়া, পেশির ব্যথা এগুলোও থাকে।
থানকুনি পাতার মধ্যে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে অ্যান্টি ইনফ্ল্যামেটারি উপাদান। যার ফলে খুব তাড়াতাড়ি জ্বালা, যন্ত্রণা কমে যায়। এছাড়াও ক্লান্তি ভাব দূর হয়। সেই সঙ্গে অনেক রকম ইনফেকশন থেকেও দূরে রাখে।
অলসারের নিরাময়ে
পেটের যে কোনও রোগে থানকুনি পাতা খুব ভালো। আমাশয় থেকে আলসার সেরে যায় এই পাতার গুণেই। আর নিয়মিত থানকুনি পাতা খেলে হজমের সমস্যা থেকে মুক্তি মেলে। ক্রনিক আমাশয়ের ক্ষেত্রে খুবই ভালো থানকুনি পাতা
মানসিক অবসাদ কমায়
যাঁরা মানসিক সমস্যায় ভুগছেন তাঁদের জন্য খুব ভালো থানকুনি পাতার রস। থানকুনি স্ট্রেস হরমোনের ক্ষরণ নিয়ন্ত্রণ করে। ফলে মানসিক চাপ আর অস্থিরতা দুই কমে। এর ফলে অ্যাংজাইটির আশঙ্কাও কমে যায়।
মস্তিষ্কের কর্মক্ষমতা বাড়ে
নিয়মিত থানকুনি পাতা খাওয়া শুরু করলে শরীরে অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট এবং পেন্টাসাক্লিক ট্রিটারপেনস নামের একটি উপাদানের মাত্রা বাড়তে শুরু করে,
যে কারণে ব্রেনসেল ভালোভাবে কাজ করতে পারে। স্মৃতিশক্তির উন্নতি তো ঘটেই, সেই সঙ্গে বুদ্ধির ধারও বাড়ে চোখে পড়ার মতো।
ঘুমের সমস্যা
প্রতিদিন সকালে উঠে থানকুনি পাতা ভেজানো জল খান। স্নায়ু শিথিল হবে। ঘুম আসবেই।
ডিটক্সিফিকেশন
গাজর কিংবা পাতিলেবুর রস শরীরের ডিটক্সিফিকেশনে সাহায্য করে। প্রতিদিন থানকুনি পাতার রসের সঙ্গে এক চামচ মধু, মিশিয়ে খান। যাবতীয় টক্সিন বেরিয়ে যাবে। শরীর থাকবে ফুরফুরে।
থানকুনি পাতা খাওয়ার অপকারিতা
থানকুনি পাতার ক্ষতি বলতে, ১-২ চামচ থানকুনি পাতার রস বা অল্প করে কাঁচা থানকুনি পাতা খেলে কোনও ক্ষতিই হয় না। কিন্তু বেশি পরিমাণে খেলেই বিপদ! সেক্ষেত্রে একাধিক সমস্যা দেখা দিতে পারে। যেমন
- মারাত্মক পেটে যন্ত্রণা হতে পারে।
- মাথা ঘোরার মতো সমস্যাও দেখা দিতে পারে।
- চুলকানি এবং অ্যালার্জিক রিঅ্যাকশন হওয়ার আশঙ্কাও থাকে।
- হঠাৎ করে রক্তচাপ কমে যাওয়ার মতো ঘটনাও ঘটতে পারে।
- যাঁরা হেপাটাইটিস বা অন্য কোনও লিভারের রোগে ভুগছেন, তাঁদেরও থানকুনি পাতা খাওয়া উচিত নয় থানকুনি পাতার ক্ষতি।
- আগামী দু’সপ্তাহে যদি কোনও অপারেশন থাকে, তা হলেও থানকুনি পাতা এড়িয়ে চলাই শ্রেয়।
থানকুনি পাতা বাটা তৈরির রেসিপি
গরম ভাতের সঙ্গেও থানকুনি পাতা খেতে পারেন। এক্ষেত্রে থানকুনি পাতার পেস্ট তৈরি করে নিতে হবে থানকুনি পাতা খাওয়ার নিয়ম। আর তার জন্য় প্রয়োজন পড়বে তিনটে থানকুনি পাতার, সঙ্গে লাগবে দুটো কাঁচা লঙ্কা, ১ চামচ কালো জিরা, ১ চামচ তেল এবং অল্প পরিমাণ চিনির।
প্রথমে থানকুনি পাতা গুলিকে ভাল করে ধুয়ে নিতে পাঁচ মিনিট হালকা গরম জলে ভিজিয়ে রাখতে হবে। সময় হয়ে গেলে জলটা ছেঁকে নিন। এরপরে মিক্সিতে থানকুনি পাতা, কালো জিরে, নুন, চিনি এবং কাঁচা লঙ্কা ফেলে একটা পেস্ট বানিয়ে নিন।
এবার হালকা আঁচে এক চামচ সরষের তেল গরম করে তাতে পেস্টটা মিশিয়ে ২ মিনিট একটু নাড়িয়ে নিন। তারপর গরম ভাতের সঙ্গে পরিবেশন করুন।
থানকুনি পাতার বড়া তৈরির পদ্ধতি
খেতে পারেন থানকুনি পাতার বড়াও। এই পদটি তৈরি করতে প্রয়োজন পড়বে ১০-১২ টা থানকুনি পাতা, ২-৩ টে কাঁচা লঙ্কা, ১ টা পেঁয়াজ, স্বাদ অনুসারে নুন, এক চিমটে হলুদ গুঁড়ো, এক চিমটে লঙ্কা গুঁড়ো, ৩ চামচ বেসন এবং পরিমাণ মতো তেলের।
প্রথমে পাতাগুলি ভাল করে ধুয়ে নিয়ে ছোট-ছোট টুকরো করে নিতে হবে। এবার একটা বাটিতে থানকুনি পাতা, পেঁয়াজ কুঁচি, লঙ্কা কুঁচি, হলুদ গুঁড়ো, লঙ্কা গুঁড়ো, নুন, পরিমাণমতো বেসন এবং অল্প করে জল নিয়ে ভাল করে মেখে ফেলতে হবে।
তারপর একটা প্যানে পরিমাণমতো তেল নিয়ে একটু গরম করে নিন। তেলটা গরম হওয়ামাত্র বেসনের মিশ্রণ থেকে অল্প-অল্প করে নিয়ে তেলে ছাড়তে থাকুন থানকুনি পাতা খাওয়ার নিয়ম।
যখন বড়ার রং হলকা খয়েরি হতে শুরু করবে, তখন প্যান থেকে তুলে একটা পাত্রে সংগ্রহ করুন। গরম ভাত আর ডালের সঙ্গে থানকুনি পাতার বড়া খেতে কিন্তু মন্দ লাগবে না।
থানকুনি পাতার ব্যবহার
শুধু পেটই নয়, আলসার, এগজিমা, হাঁপানি-সহ নানা চর্মরোগ সেরে যায় থানকুনি পাতা খেলে। ত্বকেও জেল্লা বাড়ে। ত্বকের ওজ্জ্বল্য বাড়ায় থানকুনি পাতা ৷
প্রতিদিন থানকুনি পাতা খাওয়ার অভ্যাস করলে বড় বড় রোগের থেকে জয় পাওয়া সম্ভব ৷ অ্যাংজাইটি এবং মানসিক অবসাদের প্রকোপ কমায়।
থানকুনি পাতা দেখতে কেমন?
পাতা ক্ষুদ্র গোলাকৃতির। পাতার ধারে খাঁজ রয়েছে। বাংলাদেশের সর্বত্র এই গাছটিকে দেখতে পাওয়া যায়। তবে উপকূলীয় লবনাক্ত আবহাওয়ায় এটি ভালো জন্মে।
থানকুনি পাতা মুখে দিলে কি হয়?
থানকুনির অ্যামাইনো অ্যাসিড, বিটা ক্যারোটিন, ফ্যাটি অ্যাসিড এবং ফাইটোক্যামিকেল ত্বকে প্রয়োজনীয় পুষ্টি জুগিয়ে ত্বকের আর্দ্রতা ধরে রাখতে সাহায্য করে। এতে ত্বক থাকে কোমল এবং ত্বকে বয়সের ছাপ কম দৃশ্যমান হয়।