বিট রুটের উপকারিতা, অপকারিতা এবং ব্যবহার
পুষ্টিগুণের দিক থেকে দিন দিন সুপার ফুড হিসেবে জনপ্রিয়তা পাচ্ছে বিটরুট। যদিও এটি একটি শীতকালীন ফল তবে বর্তমানে সারা বছর জুড়েই পাওয়া যায়।
বিটরুটের বৈজ্ঞানিক নাম ‘বেটা ভালগারিস’। কিছুটা কালচে লাল রঙের পেঁয়াজ আকৃতির এই ফল নানান পুষ্টিগুণ ও ঔষধি গুণে সমৃদ্ধ।
বিটরুটের পুষ্টিগুণ তালিকা
নিচের তালিকাটি একটি মাঝারি বিটরুটের (আনুমানিক ১৩৬ গ্রাম) পুষ্টিগুণের মাত্রা এবং একটি গড় প্রাপ্তবয়স্কের দৈনিক খাদ্যের প্রয়োজনীয়তা অনুযায়ী ডেইলি ভ্যালু (DV) এর শতাংশ প্রদর্শিত হয়েছে। এছাড়াও বিটরুট সম্পর্কে কিছু প্রাসঙ্গিক তথ্যও দেওয়া হলো:
পুষ্টি উপাদান | প্রতি মাঝারি বিটরুটে (আনুমানিক ১৩৬ গ্রাম) | ডেইলি ভ্যালু (DV) শতাংশ* | অন্যান্য |
---|---|---|---|
ক্যালোরি | ৬০ | ৩% | |
মোট চর্বি | ০.২ গ্রাম | ০% | |
সোডিয়াম | ১০৬ মিলিগ্রাম | ৫% | |
মোট কার্বোহাইড্রেট | ১৩ গ্রাম | ৫% | |
ডায়েটারি ফাইবার | ৩.৮ গ্রাম | ১৫% | পরিপাকের জন্য গুরুত্বপূর্ণ |
চিনি | ৯ গ্রাম | – | प्राकृतिक চিনি সহ |
প্রোটিন | ১.৭ গ্রাম | ৩% | |
ফোলেট (ভিটামিন বি৯) | ১৪৮ মাইক্রোগ্রাম | ৩৭% | কোষ বৃদ্ধি, ডিএনএ তৈরি |
পটাশিয়াম | ৫১৮ মিলিগ্রাম | ১১% | ইলেক্ট্রোলাইট, রক্তচাপ |
ম্যাঙ্গানিজ | ০.৩ মিলিগ্রাম | ১৬% | বিপাক প্রক্রিয়া, এন্টিঅক্সিডেন্ট কার্যকলাপ |
নাইট্রেট | পরিবর্তিত হয় | – | দেহে নাইট্রিক অক্সাইডে রূপান্তরিত হয় |
ডিভি (DV) গণনা করা হয়েছে ২,০০০ ক্যালোরি খাদ্যের উপর ভিত্তি করে।
অতিরিক্ত তথ্য
- অন্যান্য নাম: চুকান্দর, লাল বিট |
- প্রকার: তাজা, ক্যানজাত, রস হিসেবে, বা গুঁড়ো পাওয়া যায়।
- স্বাস্থ্য উপকারিতা (গবেষণা চলছে):
- নাইট্রেটের কারণে রক্তচাপ কমাতে পারে।
- খেলোয়াড়দের কর্মক্ষমতা বাড়াতে সাহায্য করতে পারে।
- প্রদাহ-রোধী সম্ভাবনা
- এন্টিঅক্সিডেন্টের উৎস
- বিশেষ দ্রষ্টব্য:
- মূত্র ও পায়খানা লালচে হতে পারে (ক্ষতিকর নয়)।
- বিটরুটের পাতাও খাওয়া যায় এবং পুষ্টিকর।
গুরুত্বপূর্ণ বিবেচ্য বিষয়:
- বিটরুটে অক্সালেটের পরিমাণ বেশি, যা কিডনিতে পাথর তৈরিতে ভূমিকা রাখতে পারে, বিশেষ করে সংবেদনশীল ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে।
- স্বাস্থ্যগত সমস্যা থাকলে, বিটরুটকে কীভাবে খাদ্য তালিকায় রাখা যায় সে সম্পর্কে আপনার ডাক্তারের সাথে কথা বলুন।
বিটের উপকারিতা
বিট একটি সুস্বাদু খাবার হওয়ার সাথে বেশ উপকারীও বটে শরীরের জন্য চলুন জেনে আসা যাক এর উপকারিতা গুলো।
- বিটে আছে প্রচুর ভিটামিন সি, ফোলেট, পটাশিয়াম, আয়রন ইত্যাদি। জল ও আঁশের পরিমাণ যথেষ্ট হওয়ায় হজম এবং ওজন নিয়ন্ত্রণে বিট কার্যকরি ভূমিকা পালন করে।
- বিটের মধ্যে রয়েছে নাইট্রেট নামক একটি উপাদান। এটি শরীরের রক্ত সঞ্চালন স্বাভাবিক রাখে। স্ট্রোক হওয়ার আশঙ্কা দূর করে।
- উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণেও বিট খাওয়া অত্যন্ত ভাল। তবে এ ক্ষেত্রে রান্না করা বিটের থেকে কাঁচা বিট বেশি কার্যকরী।
- বিটে থাকা বিটালাইন নামক ফাইটোনিউট্রিয়েন্ট কিডনিসহ আরও অঙ্গপ্রত্যঙ্গের প্রদাহকে কমাতে সাহায্য় করে বলে জানা গিয়েছে।
- পেটের বিভিন্ন রোগ যেমন জন্ডিস, ডায়েরিয়া ও কলেরা প্রভৃতি নিরাময়ে খুবই উপকারী। ফ্যাটি লিভারের সমস্যাও নিয়ন্ত্রণ করে বিট।
- গেঁটে বাত বা আর্থ্রাইটিসের ব্যথা উপশমে বিট জুসের সক্রিয় ভূমিকা দেখা গেছে। এক কাপ বিটরুটে প্রায় ৩.৪ গ্রাম ফাইবার রয়েছে। তাই বদহজম, কোষ্ঠকাঠিন্য, পেটের প্রদাহে নিয়মিত বিট খেলে বেশ উপকার মেলে।
- বিটের নাইট্রেট উপাদান মস্তিষ্কে রক্ত সঞ্চালন বাড়িয়ে দিয়ে বার্ধক্যজনিত বিভিন্ন মানসিক সমস্যা, যেমন, ডিমেনশিয়া, স্মৃতিভ্রংশ ইত্যাদির হাত থেকে বাঁচাতে সাহায্য করে।
- বিটে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট। অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট শরীরের রোগ প্রতিরোধক্ষমতা বাড়িয়ে দেয়।
- বিট হাড় শক্ত করতে সাহায্য করে। শরীরে ক্যালসিয়াম ধরে রাখতে সাহায্য করে বিট। অল্প বয়স থেকে বিট খেলে বয়সকালে হাড়ের সমস্যা দেখা দেওয়ার প্রবণতা কমে।
- বিটে প্রচুর পরিমাণে আয়রন রয়েছে। অ্যানিমিয়া, রক্তসল্পতায় বিট খুবই উপকারী। শরীরে রক্তের ঘাটতি পূরণ করতে সহায়তা করে।
বিটের অপকারিতা
এটি একটি স্বাস্থ্যকর খাদ্য হওয়ার শর্তেও শরীরের কিছু কিছু ক্ষেত্রে এটি অপকারী কাজ করে। চলুন জেনে আসা যাক এর অপকারিতা গুলো।
নিম্ন রক্তচাপ আছে এমন ব্যক্তিদের বিট খাওয়া উচিত নয়
নিম্ন রক্তচাপের জন্য বিট খাওয়া ক্ষতিকারক হতে পারে। এর কারণ, বিটে প্রাকৃতিকভাবে উচ্চ মাত্রার নাইট্রেট থাকে যা আপনার পরিপাকতন্ত্রকে নাইট্রিক অক্সাইডে রূপান্তরিত করে।
এই উপাদানটি রক্তনালীগুলিকে শিথিল করে এবং প্রসারিত করে, যা রক্তচাপকে আরও কমিয়ে দেয়। তাই নিম্ন রক্তচাপের সমস্যায় ভুগছেন এমন ব্যক্তিদের বিট এড়িয়ে চলা উচিত।
গলব্লাডারে পাথর হয়েছে এমন রোগীদের জন্য ক্ষতিকর
কিডনিতে পাথর না থাকলে বিট খেলে কোনো বিপদ নেই। তবে, কারোর যদি অক্সালেটযুক্ত কিডনিতে পাথর থাকে তবে তাঁদের জন্য বিটরুট ক্ষতিকারক হতে পারে।
আসলে, বিটে অক্সালেটের পরিমাণ অনেক বেশি, যার কারণে কিডনিতে পাথরের সমস্যা আরও গুরুতর হয়ে ওঠে। আপনি যদি পাথরের সমস্যায় ভুগছেন, তবে আপনার চিকিৎসক বিটরুট এড়িয়ে চলা বা পরিমিত পরিমাণে সেবন করার পরামর্শ দেন
অ্যালার্জিযুক্ত ব্যক্তিদের বিট এড়ানো উচিত
বিটের রসে খনিজ, অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট, ভিটামিন, ফাইটোনিউট্রিয়েন্টস, পলিফেনল এবং অন্যান্য খাদ্যতালিকাগত ফাইবার-সহ পুষ্টির একটি ভাণ্ডার। কিন্তু এই পুষ্টি কিছু মানুষের অ্যালার্জির কারণ হতে পারে। যার ফলে ত্বকে ফুসকুড়ি, আমবাত, চুলকানি, ঠান্ডা লাগা এবং জ্বর হতে পারে।
অতএব, আপনার যদি বিটরুটে অ্যালার্জি থাকে তবে এটি কোনওভাবেই খাওয়া উচিত নয়। এটি আপনার অ্যালার্জি এবং ত্বকের সমস্যা বাড়িয়ে তুলতে পারে।
ডায়াবিটিস রোগীদের জন্য ক্ষতিকর
বিট স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী হলেও ডায়াবিটিস রোগীদের তা খাওয়া এড়িয়ে চলা উচিত। ডায়াবিটিস রোগীদের প্রায়ই স্নায়ুর ক্ষতির ঝুঁকি থাকে, যা অপরিবর্তনীয়। এই বিপদ ঠেকাতে হলে দরকার পরম যত্ন।
বিশেষ করে ডায়াবিটিস রোগীরা বিট খেলে এর ফাইবার ভেঙে যায় এবং গ্লাইসেমিক লোড উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পায়। হ্যাঁ, ডায়াবেটিস রোগীরা খুব অল্প পরিমাণে বিট বা বিটের রস খেতে পারেন। কারণ এতে উপস্থিত নাইট্রেট অক্সাইড উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে খুবই কার্যকরী।
বিট খাওয়ার নিয়ম
বিটরুট প্রায় সারা বছরই পাওয়া যায়। এটি সালাদ, সবজি এবং জুস আকারে খাওয়া হয়। অনেকে আবার সবজি হিসেবে রান্না করে খেয়ে থাকেন।
তবে বিভিন্ন ফলের সাথে মিশিয়ে জুস হিসেবে বেশি খেয়ে থাকেন স্বাস্থ্য সচেতনরা।
বিট জুস
ওজন কমানোর উদ্দেশ্যে অনেক কিছুই করি আমরা। তেমন কোনো পরিশ্রম না করেই ওজন কমানোর আকর্ষণটা এড়াতে পারে না কেউই। কিন্তু চট করে ওজন কমানোর ডায়েটগুলো প্রথম কিছুদিন কাজ করলেও আবার ওজন বাড়িয়ে দেয় এমনকি আমাদের অসুস্থ করে ফেলে। এমন পরিস্থিতি এড়াতে চাইলে স্বাস্থ্যকর খাবার খেয়েই আপনাকে ওজন কমাতে হবে।
এক্ষেত্রে ভালো একটি খাবার হলো বিটরুট। একে প্রায়ই সুপারফুড বলে আখ্যা দেওয়া হয়। কারণ তা খুবই পুষ্টিকর। প্রচুর ভিটামিন ও মিনারেলসের পাশাপাশি এতে অনেকটা ফাইবারও থাকে, ফলে তা অনেকটা সময় পেট ভরা রাখে ও ওজন কমাতে কাজে আসে। আর এতে ক্যালোরিও থাকে কম। ১০০ মিলি বিটের জুসে থাকে মাত্র ৩৫ ক্যালোরি।
দেখে নিন বিটের জুস তৈরি করার ৪টি উপায়-
গাজর ও বিটের জুস
গাজরে সলিউবল ও ইনসলিউবল- দুই ধরনের ফাইবার বা খাদ্য আঁশ থাকে। এগুলো হজম হতে দেরি হয় ও বেশি সময় পেট ভরা রাখে। তাই বিটের জুসে গাজর যোগ করতে পারেন।
২ কাপ বিট
২ কাপ গাজর
আধা কাপ পানি
৫ টেবিল চামচ লেবুর রস
এক চিমটি লবণ
কয়েকটা পুদিনা পাতা
বিট, গাজর ও পুদিনা পাতা একসাথে ব্লেন্ড করে নিন। এতে পানি, লেবুর রস ও লবণ নেড়ে মিশিয়ে নিন।
আপেল ও বিটের জুস
আপেল ফলটি মিষ্টি হলেও তাতে খুবই কম ক্যালোরি থাকে। তাই স্বাদ বাড়াতে বিটের জুসে একে যোগ করতে পারেন।
২ কাপ বিট
১ কাপ আপেল
দারুচিনি গুঁড়ো
লবণ ও গোলমরিচ গুঁড়ো
সব উপকরণ একসাথে ব্লেন্ড করে নিন।
ডালিম ও বিটের জুস
ডালিমের গুণ হলো, এতে আছে প্রচুর অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট। ফলটিতে বি কমপ্লেক্স ভিটামিন থাকার কারণে তা হজমে সাহায্য করে। তাতে ফাইবারও থাকে অনেকটা। এছাড়া ফলটি মেটাবলিজম বাড়ায় ও ফ্যাট বার্ন করতে কাজে আসে।
২ কাপ বিট
১ কাপ ডালিমের বীজ
৩ টেবিল চামচ লেবুর রস
বিটলবণ
বিট ও ডালিম ভালোভাবে ব্লেন্ড করে নিন। এতে লেবুর রস ও বিটলবণ দিয়ে নেড়ে নিন।
টমেটো ও বিটের জুস
আপেলের মতো টমেটোতেও অনেক কম ক্যালোরি থাকে। এতে পানির পরিমাণ থাকে বেশি।
২ কাপ বিট
দেড় কাপ টমেটো ৩ টেবিল চামচ লেবুর রস
পুদিনা পাতা
লবণ
বিট, টমেটো ও পুদিনা পাতা একসাথে ব্লেন্ড করে নিন। এরপর লেবুর রস ও লবণ দিয়ে নেড়ে নিন।
বিটের জুস নিয়মিত খাওয়া খুবই স্বাস্থ্যকর। তবে আপনার মল ও মূত্রের রঙ একটু পাল্টে যেতে পারে, এতে চিন্তার কিছু নেই। যাদের বাতের সমস্যা ও কিডনির সমস্যা আছে তারা এই জুস পান করার আগে ডাক্তারের সাথে কথা বলে নিন।