চালকুমড়োর পুষ্টিগুণ, উপকারিতা এবং কিছু রেসিপি
চালকুমড়া উদ্ভিদ লতা জাতীয়। এর ফল বিশালাকার যেটা সবজি হিসেবে খাওয়া হয় বা মোরব্বা বানিয়ে খাওয়া হয়। কচি চালকুমড়ার গায়ে রোম থাকে; পরিপক্ব হলে রোমের পরিবর্তে এর গায়ে সাদা সাদা পাউডারের মত পদার্থের আবরণ হয়।
এই পাউডারের জন্যই এটি দীর্ঘ সময় সংরক্ষণ করা সম্ভব হয়। চালকুমড়া ৮০ সেমি পর্যন্ত লম্বা হতে পারে। এটি দক্ষিণ, দক্ষিণ-পূর্ব এবং পূর্ব এশিয়াতে প্রচুর পরিমাণে চাষ করা হয়।
চালকুমড়া বাংলাদেশের জনপ্রিয় ফল জাতীয় সবজি। বাজারে আমরা দু রকমের কুমড়া দেখতে পাই— লাল বা হলুদ কুমড়া। আর সাদা চালকুমড়া। দামে অপেক্ষাকৃত কম হলেও দু ধরনের কুমড়াই গুণের আধার।
চালকুমড়ার বৈজ্ঞানিক নাম বেনিনকাসা হিসপিডা। করোনাকালে ডাক্তাররা হলুদ রঙের ফল, হলুদ রঙের তরকারি বেশি করে খেতে বলছেন। কারণ এগুলোতেই আছে বেশি মাত্রায় স্বাস্থ্যের পক্ষে প্রয়োজনীয় ভিটামিন।
চাল কুমড়ায় কি কি পুষ্টিগুণ আছে
চাল কুমড়া নানা পুষ্টিগুণে সমৃদ্ধ। প্রতি ১০০ গ্রাম চাল কুমড়ায় রয়েছে খাদ্যশক্তি ১৩ কিলোক্যালরি, আমিষ ০.৪ গ্রাম,শর্করা ৩ গ্রাম, ফাইবার ২.৯ গ্রাম,চর্বি ০.২ গ্রাম,ভিটামিন সি ১০.১ মিলিগ্রাম,পটাশিয়াম ১৫০ মিলিগ্রাম, ম্যাগনেসিয়াম ১১ মিলিগ্রাম, ক্যালসিয়াম ২৬ মিলিগ্রাম। চাল কুমড়ার উপকারিতা বলে শেষ করা সম্ভব নয়।
১০০ গ্রাম চালকুমড়োতে পাওয়া পুষ্টি উপাদান (আনুমানিক) এবং দৈনিক চাহিদা পূরণের শতাংশ (আনুমানিক)
পুষ্টি উপাদান | পরিমাণ (আনুমানিক) | দৈনিক চাহিদা পূরণের শতাংশ (আনুমানিক)* |
---|---|---|
ক্যালোরি | ১৩ | ০.৬৫% |
মোট কার্বোহাইড্রেট | ৩ গ্রাম | ১% |
ফাইবার | ১ গ্রাম | ৪% |
চিনি | ১ গ্রাম | নগণ্য |
প্রোটিন | ০.৬ গ্রাম | ১.২% |
ভিটামিন সি | ১৩ মিলিগ্রাম | ১৭.৩৩% |
ভিটামিন বি ১ (থিয়ামিন) | ০.০৪ মিলিগ্রাম | ৩.৩৩% |
পটাশিয়াম | ১৩৬ মিলিগ্রাম | ২.৯% |
ম্যাগনেসিয়াম | ১০ মিলিগ্রাম | ২.৫% |
ক্যালসিয়াম | ১৯ মিলিগ্রাম | ১.৯% |
*একটি ২০০০ ক্যালোরির ডায়েট এবং গড় প্রাপ্তবয়স্কদের চাহিদার উপর ভিত্তি করে।
চালকুমড়ার উপকারিতা
এতে থাকা উপকারী কিছু অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট বিভিন্ন রোগ থেকে রক্ষা পেতে সাহায্য করে। চলুন জেনে নেওয়া যাক উপকারী সবজি চালকুমড়া খেলে কী উপকারিতা পাওয়া যায়-
হজমের সমস্যা দূর করে
হজমের সমস্যায় ভুগলে তার একটি সহজ সমাধান হতে পারে চালকুমড়া খাওয়া। এতে থাকে পর্যাপ্ত ফাইবার ও পানি। এই দুই উপাদান অন্ত্রের স্বাস্থ্য ভালো রাখতে কাজ করে।
গ্যাস, অ্যাসিডিটি, কোষ্ঠকাঠিন্যসহ বিভিন্ন পেটের সমস্যায় ভুগলে নিয়মিত চালকুমড়া খেতে পারেন। তাহলে আর পেটের স্বাস্থ্য নিয়ে চিন্তা না করলেও চলবে।
আলসার সারাতে কাজ করে
পেটের আলসারে আক্রান্ত হলে খাবারের ক্ষেত্রে অনেকটাই সচেতন হতে হয়। এই রোগের কারণে পাকস্থলীতে ক্ষত তৈরি হয়।গবেষণায় দেখা গেছে, নিয়মিত চালকুমড়া খেলে এই সমস্যার দ্রুত সমাধান সম্ভব হয়। তাই পেটের আলসার সারাতে চালকুমড়া রাখাতে পারেন খাবারের তালিকায়। এতে দ্রুতই উপকার পাবেন।
শরীরে প্রশান্তি দেয়
শরীরে প্রশান্তি বজায় থাকা জরুরি। নয়তো আপনার মেজাজ খিটখিটে হয়ে থাকবে, ভালো কথা শুনতেও ভালোলাগবে না। শরীরের অস্থিরতা দূর করে প্রশান্তি এনে দিতে কাজ করে চালকুমড়া।
এই সবজিতে থাকে প্রচুর সিডেটিভ প্রপার্টিজ যা শরীরকে শান্ত করতে সাহায্য করে। যে কারণে ঘুমও আসে সহজে।
ফুসফুস ভালো রাখে
ফুসফুস ভালো রাখার জন্য অন্যতম কার্যকরী খাবার হলো চালকুমড়া। অ্যাজমাসহ নিঃশ্বাসের অন্যান্য সমস্যায় ভুগলে রোগীর প্রতিদিনের খাবারে চালকুমড়া রাখতে পারেন।
এর অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট বৈশিষ্ট্য এ ধরনের সমস্যাকে প্রশমিত করতে সাহায্য করে। সেইসঙ্গে ফুসফুসে জমে থাকা কফ ও দূষিত পদার্থ বের করে দিতেও কাজ করে এই সবজি।
শক্তি বাড়ায়
বর্ষাকাল হলেও গরম পড়ছে বেশ। ভ্যাপসা গরমে ঘামের কারণে আমাদের শক্তি কমে যাচ্ছে অনেকটাই। ফলে দিনশেষে ক্লান্তি এসে ভর করছে। এ ধরনের সমস্যায় সমাধান হিসেবে কাজ করতে পারে চালকুমড়া।
এই সবজিতে থাকে প্রচুর ভিটামিন বি৩। এই ভিটামিন দ্রুত শক্তি বাড়াতে কাজ করে। তাই নিয়মিত পাতে রাখুন এই সবজি।
রক্তপিত্ত
রক্ত উঠলেই টি বি হয়েছে যেমন ধরে নেওয়া উচিত নয়, সেই রকম রক্ত পড়লেই অর্শ হয়েছে একথা ভাবাও সমীচীন নয়; বৈদ্যকের ভাষায় এটিও রক্তপিত্ত রোগের অন্তর্গত।
এরকম ক্ষেত্রে পাকা চালকুমড়ার রস ৩ থেকে ৪ চা চামচ একটু, চিনি মিশিয়ে খাবেন। রক্ত ওঠা বা পড়া যেটাই হোক না কেনো, বন্ধ হবে। আরও ভালো হয় একটু, বাসক পাতার রস ঐ সঙ্গে মিশিয়ে খাওয়া।
হৃদ্গত রোগ
হৃদযন্ত্রের বৃদ্ধি হলে বা ঝুলে গেলে কি অসুবিধে হয় সব চিকিৎসকই জানেন। এক্ষেত্রে রোগীকে পাকা চালকুমড়ার হালুয়া খাওয়ানোর অভ্যাস করলে ভালো হবে; তবে হালুয়াতে গরুর থেকে ছাগলের দুধ দিলে ভাল হয়। এই সবজি বলকারক, পুষ্টিকর, ফুসফুসও ভাল রাখে।
কোষ্ঠকাঠিন্যে
বালক বা বৃদ্ধ এই দুজনের একই জ্বালা অর্থাৎ সব রকম দাস্ত পরিষ্কারের ওষুধ খাইয়েও ফল হয় না, এ সময় চিকিৎসক বিভ্রান্ত হন। এক্ষেত্রে বৃহদন্ত্রের শুষ্কতা সৃষ্টি আয়ুর্বেদের নিদান।
একে স্বাভাবিক করতে গেলে চালকুমড়ার রস ৪ থেকে ৫ চা-চামচ গরম দুখের সঙ্গে খাওয়াতে হয়। এটাতে প্রস্রাব ও দাস্ত দুটোই পরিষ্কার হয়।
যক্ষ্মা সন্দেহ
প্রাথমিক লক্ষণ সব মিলে যাচ্ছে তখন প্রারম্ভিক চিকিৎসা হিসাবে এই চালকুমড়োর রস ৪ থেকে ৫ চা-চামচ একটু চিনি ও দুধ মিশিয়ে দু’বেলা খেতে দিয়ে তার উপকারিতা প্রত্যক্ষ করুন।
কোনো কোনো চিকিৎসকের মতে যক্ষ্মা, অর্শ, গ্রহণী একটানা পেটের অসুখ প্রভৃতি অসুখেও চালকুমড়া খেলে উপকার হয়।
চালকুমড়ার মোরব্বা
উপকরন
চুনপড়া চালকুমড়া – ২ কেজি, চিনি – ৪ কেজি, চুন – সামান্য, খাওয়ার সোডা – ১ চা চামচ।
প্রনালী
প্রথমে পাকা চুনপড়া চালকুমড়ার খোসা ছাড়িয়ে চার ফালি করে কেটে নিন। বীচির নরম অংশ কেটে ফেলে লম্বা সাইজের বড় টুকরা করে নিন। তারপর কাটা চামচ বা খেজুর কাটা দিয়ে কেচে নিন। পানিতে চুন মাঠার মত গুলে ৩-৪ ঘন্টা ভিজিয়ে রাখুন।
চুনের পানি থেকে তুলে কুমড়া ভাল করে ধুয়ে নিন। এবার ডুবো পানিতে কয়েক মিনিট সিদ্ধ করে চুলা থেকে নামিয়ে পানি ঝরিয়ে নিন। এরপর চিনির মধ্যে পানি মিশিয়ে সিরা তৈরি করে নিন।
তারপর চালকুমড়া দিয়ে চুলায় আচ দিতে থাকুন। ৩-৪ ঘন্টা চুলায় আচ দেওয়ার পর সিরা খুব ঘন ও আঠালো হলে খাওয়ার সোডা পানিতে গুলে দিন। চিনি ঘন হয়ে আসলে নাড়তে থাকুন। হাঁড়ি চুলা থেকে নামিয়ে সামান্য ক্যাৎ করে রাখুন যেন নীচে সিরা জমে।
জমানো সিরা তুলে তুলে মোরব্বা উপর দিতে থাকুন। এভাবে বেশ কিছুক্ষন মোরব্বার উপর সিরা দিয়ে মোরব্বা ভিজিয়ে দিন। এবার পরিষ্কার প্লাস্টিকের টেবিল ক্লথ বা কাগজের উপর মোরব্বা আলাদা আলাদা করে বাতাসে রাখুন।
প্রত্যেকটা টুকরা আঙ্গুল দিয়ে পরীক্ষা করবেন উপরে চিনি জমানো ভাব লাগে কিনা। যদি চিনি জমানো ভাব না হয় তাহলে আবার সিরায় ডুবিয়ে নিবেন। মোরব্বা ঠান্ডা হয়ে চিনি সম্পূর্ন রুপে জমে গেলে বৈয়ামে রেখে পরিবেশন করুন।
চালকুমড়ার মিঠাই
উপকরণ
চালকুমড়া ১টা, খেজুর রস ১ লিটার, দুধ ১ লিটার, কিশমিশ ১০-১৫টা, তেজপাতা ২টা, দারুচিনি ২-৩ টুকরা, নারিকেল বাটা আধাকাপ, ঘি ১ টেবিল চামচ।
প্রণালি
খেজুর রস ১ লিটার জ্বাল দিয়ে ১ কাপ করতে হবে। চুলায় কড়াইয়ে ঘি দিয়ে তাতে তেজপাতা, দারুচিনি ভেঙে দিয়ে বড় করে টুকরা করা চালকুমড়া দিয়ে ভাজতে হবে।
দুধের সঙ্গে গুড় মিশিয়ে এতে ঢেলে দিতে হবে। অল্প আঁচে কিছুক্ষণ রাখতে হবে। কুমড়া ভালোভাবে সিদ্ধ হলে বাকি উপকরণ দিয়ে পাঁচ মিনিট পর নামাতে হবে। খাবার শেষে মিষ্টান্ন হিসেবে ভাত ও অথবা পোলাওয়ের সঙ্গে পরিবেশন করতে পারেন।
চাল কুমড়ার বীজ কি খাওয়া যায়?
পরিমাণে বেশি নয়, কুমড়ার বীজ নাস্তায় কিংবা সালাদের সঙ্গে মিশিয়ে খাওয়া বেশি উপকারী। নানান রকমের পুষ্টিগুণ থাকায় কুমড়ার বীজ ‘সুপার ফুড’ হিসেবে বিবেচিত। কুমড়ার বীজ মূল্যবান পুষ্টি এবং অ্যান্টিঅক্সিডেন্টে ভরপুর যা আমাদেরকে ম্যাগনেসিয়াম, জিঙ্ক, আঁশ, স্বাস্থ্যকর চর্বির যোগান দেয়।