হার্ট ভালো রাখার উপায়
হার্ট বা হৃদপিণ্ড আমাদের দেহের একটি অত্যাবশ্যক অঙ্গ। এটি রক্তকে দেহের বিভিন্ন অংশে পাম্প করে পুষ্টি ও অক্সিজেন সরবরাহ করে, বর্জ্য পদার্থ অপসারণ করে, এবং দেহের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে।
হার্টের সুস্থতা আমাদের সার্বিক সুস্বাস্থ্যের একটি প্রধান অংশ। হার্টের বিভিন্ন সমস্যা বা রোগ, যেমন করোনারি হার্ট ডিজিজ, হার্ট ফেইলিওর, এবং অ্যারিথমিয়া জীবননাশক হতে পারে।
যদিও হার্টের রোগের ঝুঁকির কয়েকটি কারণ আমাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে, তবুও আমরা স্বাস্থ্যকর জীবনধারা গড়ে তুলে এই ঝুঁকি অনেকাংশে কমাতে পারি। এই নিবন্ধে, আমরা হৃদয়কে সুস্থ রাখার জন্য কিছু গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নিয়ে আলোচনা করব।
সুষম খাদ্য এবং নিয়মিত শারীরিক কসরত
সুষম খাদ্য এবং নিয়মিত শারীরিক কসরত হার্ট ভালো রাখার দুটি স্তম্ভ।
সুষম খাদ্য
- ফল, শাকসবজি ও গোটা শস্য জাতীয় খাবারে পুষ্টি ও ফাইবার সমৃদ্ধ, এগুলো হার্টের জন্য উপকারী।
- স্যাচুরেটেড ফ্যাট, ট্রান্স ফ্যাট, অতিরিক্ত লবণ ও চিনি যুক্ত খাবার হৃৎপিণ্ডের জন্য ক্ষতিকর।
- খাদ্যে প্রচুর পরিমাণে ফাইবার যুক্ত করুন।
- খাবারের পরিমাণ নিয়ন্ত্রণ করুন।
নিয়মিত শারীরিক কসরত
- প্রতি সপ্তাহে অন্তত ১৫০ মিনিট মাঝারি-তীব্রতার অ্যারোবিক ব্যায়াম বা ৭৫ মিনিট উচ্চ-তীব্রতার এরোবিক এক্সারসাইজ করার চেষ্টা করুন।
- শারীরিক কসরত রক্তচাপ কমাতে, কোলেস্টেরলের মাত্রা উন্নত করতে ও ওজন নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে।
ধূমপান এবং অতিরিক্ত মদ্যপান এড়িয়ে চলা
ধূমপান
- ধূমপান হৃদরোগের ঝুঁকি অনেকাংশে বাড়িয়ে দেয়।
- ধূমপান তামাকের ধোঁয়া হৃৎপিণ্ডের পেশীগুলিকে ক্ষতিগ্রস্ত করে, রক্তনালীগুলির ক্ষতি করে এবং রক্ত জমাট বাঁধতে পারে।
- ধূমপানের ফলে হৃদরোগ, স্ট্রোক, ফুসফুসের ক্যান্সার এবং অন্যান্য গুরুতর স্বাস্থ্য সমস্যার ঝুঁকি বৃদ্ধি পায়।
- ধূমপান ত্যাগ করা হার্ট ভালো রাখার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
- ধূমপান ত্যাগ করার ফলে হৃদরোগের ঝুঁকি দ্রুত কমে যায়।
- ধূমপান ত্যাগ করার ৫ বছরের মধ্যে হৃদরোগের ঝুঁকি অর্ধেক কমে যায়।
- ধূমপান ত্যাগ করার ১০ বছরের মধ্যে হৃদরোগের ঝুঁকি ধূমপানকারীদের মতো একই স্তরে নেমে আসে।
ধূমপান ত্যাগ করার উপায়
নিজের ইচ্ছাশক্তি
- ধূমপান ত্যাগ করার জন্য প্রথমেই দৃঢ় ইচ্ছাশক্তি থাকা প্রয়োজন।
- ধূমপান ত্যাগের সুবিধাগুলি সম্পর্কে সচেতন থাকুন।
পরিবার ও বন্ধুদের সহায়তা
- পরিবার ও বন্ধুদের সহায়তা ধূমপান ত্যাগে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
- ধূমপান ত্যাগের সিদ্ধান্ত সম্পর্কে তাদের জানান এবং তাদের সহায়তা চাই।
পেশাদার সহায়তা
- ধূমপান ত্যাগের জন্য বিভিন্ন পেশাদার সহায়তা পাওয়া যায়।
- ডাক্তার, কাউন্সেলর, ও ধূমপান ত্যাগের ক্লিনিকগুলির সাহায্য নিতে পারেন।
অতিরিক্ত মদ্যপান
- অতিরিক্ত মদ্যপান হার্টের জন্য ক্ষতিকর।
- অতিরিক্ত মদ্যপান রক্তচাপ বাড়িয়ে দেয়, হার্টের পেশি দুর্বল করে দেয়, ও অনিয়মিত হৃৎস্পন্দনের কারণ হয়।
- অতিরিক্ত মদ্যপানের ফলে হৃদরোগ, স্ট্রোক, লিভারের ক্ষতি, এবং অন্যান্য গুরুতর স্বাস্থ্য সমস্যার ঝুঁকি বৃদ্ধি পায়।
- মদ্যপান অভ্যাস থাকলে তা কমানো এবং সম্ভব হলে পুরোপুরি পরিহার করা উচিত।
- পুরুষদের জন্য প্রতিদিন ২ টির বেশি এবং মহিলাদের জন্য ১ টির বেশি মদ্যপান করা উচিত নয়।
- গর্ভবতী মহিলাদের সম্পূর্ণভাবে মদ্যপান করা উচিত নয়।
মদ্যপান কমানোর উপায়:
নিজের ইচ্ছাশক্তি
- মদ্যপান কমানোর জন্য প্রথমেই দৃঢ় ইচ্ছাশক্তি থাকা প্রয়োজন।
- মদ্যপান কমানোর সুবিধাগুলি সম্পর্কে সচেতন থাকুন।
পানীয়ের পরিমাণ কমান
- * প্রতিটি পানীয়ে কতটুকু মদ আছে তা গভীরভাবে খেয়াল করুন।
- * ছোট গ্লাস ব্যবহার করুন।
- * মদের সাথে সোডা বা জল মেশান।
পরিবার ও বন্ধুদের সহায়তা
- * পরিবার ও বন্ধুদের সহায়তা মদ্যপান কমাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
- * মদ্যপান কমানোর সিদ্ধান্ত সম্পর্কে তাদের জানান এবং তাদের সহায়তা চাই।
পেশাদার সহায়তা
- * মদ্যপানে আসক্তি থাকলে মদ্যপান কমানোর জন্য বিভিন্ন পেশাদার সহায়তা পাওয়া যায়।
* ডাক্তার, কাউন্সেলর, ও মাদকাসক্তি দূরীকরণ ক্লিনিকগুলির সাহায্য নিতে পারেন।
গুরুত্বপূর্ণ পরামর্শ:
- ধূমপান ও মদ্যপান উভয়ই হার্টের জন্য ক্ষতিকর।
- হার্টের স্বাস্থ্যের জন্য এই ক্ষতিকর অভ্যাসগুলো সম্পূর্ণরূপে ত্যাগ করাই সবচেয়ে ভালো পন্থা।
- যদি আপনার ধূমপান ত্যাগ অথবা মাদকাসক্তি দূর করতে সমস্যা হয়, তবে আপনার ডাক্তার বা একজন পেশাদারের সহায়তা নিন।
ওজন, ব্লাড প্রেসার, কোলেস্টেরল, এবং রক্তের শর্করা নিয়মিতভাবে পরীক্ষা করানো
ওজন
- ওজন বেশি হলে হার্টের ওপর বাড়তি চাপ পড়ে।
- অতিরিক্ত ওজন হৃৎপিণ্ডের পেশীগুলিকে অতিরিক্ত কাজ করতে বাধ্য করে, যার ফলে হৃৎপিণ্ডের ব্যর্থতা, হৃদরোগ এবং অন্যান্য জটিলতা দেখা দিতে পারে।
- ওজন বেশি হলে শ্বাসকষ্ট, ঘুমের অ্যাপনিয়া, এবং টাইপ 2 ডায়াবেটিসের ঝুঁকিও বৃদ্ধি পায়।
- আদর্শ ওজন বজায় রাখা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
- আপনার আদর্শ ওজন নির্ধারণ করতে আপনার ডাক্তারের সাথে কথা বলুন।
- স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস এবং নিয়মিত ব্যায়ামের মাধ্যমে আপনার আদর্শ ওজন বজায় রাখুন।
ওজন কমানোর উপায়
স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস:
- ফল, শাকসবজি, এবং গোটা শস্য জাতীয় খাবার খান।
- স্যাচুরেটেড ফ্যাট, ট্রান্স ফ্যাট, অতিরিক্ত লবণ ও চিনি যুক্ত খাবার এড়িয়ে চলুন।
নিয়মিত ব্যায়াম
- প্রতি সপ্তাহে অন্তত ১ বার।
- ৫০ মিনিট মাঝারি-তীব্রতার অ্যারোবিক ব্যায়াম বা ৭৫ মিনিট উচ্চ-তীব্রতার এরোবিক এক্সারসাইজ করার চেষ্টা করুন।
আচরণগত পরিবর্তন
- অতিরিক্ত খাওয়া এড়িয়ে চলুন।
- নিয়মিত খাওয়ার অভ্যাস গড়ে তুলুন।
- পর্যাপ্ত পরিমাণে ঘুমান।
- মানসিক চাপ নিয়ন্ত্রণ করুন।
ব্লাড প্রেসার
- উচ্চ রক্তচাপ হৃদরোগ, স্ট্রোকের ঝুঁকি বাড়ায়।
- উচ্চ রক্তচাপ হৃৎপিণ্ডের পেশীগুলিকে ক্ষতিগ্রস্ত করে এবং রক্তনালীগুলিকে শক্ত করে তোলে, যার ফলে হৃদরোগ এবং স্ট্রোকের ঝুঁকি বৃদ্ধি পায়।
- নিয়মিত ব্লাড প্রেসার পরীক্ষা করান।
- প্রতি বছর অন্তত একবার ব্লাড প্রেসার পরীক্ষা করা উচিত।
- যদি আপনার উচ্চ রক্তচাপ থাকে, তাহলে নিয়মিত ব্লাড প্রেসার পরীক্ষা করা উচিত।
রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখার উপায়
- স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস।
- ফল, শাকসবজি, এবং গোটা শস্য জাতীয় খাবার খান।
- স্যাচুরেটেড ফ্যাট, ট্রান্স ফ্যাট, অতিরিক্ত লবণ ও চিনি যুক্ত খাবার এড়িয়ে চলুন।
- নিয়মিত ব্যায়াম।
- প্রতি সপ্তাহে অন্তত ১৫০ মিনিট মাঝারি-তীব্রতার অ্যারোবিক ব্যায়াম বা ৭৫ মিনিট উচ্চ-তীব্রতার এরোবিক এক্সারসাইজ করার চেষ্টা করুন।
- ওজন কমানো বা বজায় রাখা।
- * ধূমপান বর্জন।
- * স্ট্রেস বা মানসিক চাপ নিয়ন্ত্রণ।
* চিকিৎসক প্রদত্ত উচ্চরক্তচাপের ওষুধ সেবন।
কোলেস্টেরল
- উচ্চ কোলেস্টেরল, বিশেষত (LDL) কোলেস্টেরলের মাত্রা বেশি হলে হার্টের সমস্যার ঝুঁকি বাড়ে।
- উচ্চ কোলেস্টেরল রক্তনালীতে জমা হয়ে ফ্যাটি প্লাক তৈরি করে, যা ধমনীগুলিকে সংকীর্ণ ও শক্ত করে। ফলে রক্ত প্রবাহ ব্যাহত হয়, যার ফলে হৃদরোগ, স্ট্রোকের ঝুঁকি বৃদ্ধি পায়।
- নিয়মিতভাবে কোলেস্টেরলের মাত্রা পরীক্ষা করা জরুরী।
- 20 বছরের বেশি বয়সী প্রত্যেকের প্রতি 4 থেকে 6 বছরে অন্তত একবার কোলেস্টেরলের মাত্রা পরীক্ষা করা উচিত।
- যদি আপনার হার্টের সমস্যার উচ্চ ঝুঁকি থাকে, তাহলে আপনার ডাক্তার আরও ঘন ঘন পরীক্ষার পরামর্শ দিতে পারেন।
কোলেস্টেরলের মাত্রা কমানোর উপায়
- স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস:
- ফল, শাকসবজি, এবং গোটা শস্য জাতীয় খাবার খান।
- স্যাচুরেটেড ফ্যাট, ট্রান্স ফ্যাট, অতিরিক্ত লবণ ও চিনি যুক্ত খাবার এড়িয়ে চলুন।
- নিয়মিত ব্যায়াম।
- প্রতি সপ্তাহে অন্তত ১৫০ মিনিট মাঝারি-তীব্রতার অ্যারোবিক ব্যায়াম বা ৭৫ মিনিট উচ্চ-তীব্রতার এরোবিক এক্সারসাইজ করার চেষ্টা করুন।
- ওজন কমানো বা বজায় রাখা।
- ধূমপান বর্জন।
- চিকিৎসক প্রদত্ত কোলেস্টেরল হ্রাসকারী ওষুধ সেবন।
রক্তের শর্করা
- ডায়াবেটিস হার্টের পক্ষে ক্ষতিকর।
- ডায়াবেটিস রক্তে শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখতে সমস্যা সৃষ্টি করে। উচ্চ রক্তের শর্করা হৃৎপিণ্ড, রক্তনালী, কিডনি এবং স্নায়ুগুলিকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে।
- ডায়াবেটিস, হৃদরোগ, স্ট্রোক এবং অন্যান্য গুরুতর জটিলতার ঝুঁকি বাড়ায়।
- রক্তের শর্করা পরীক্ষা করা জরুরী, বিশেষ করে প্রি-ডায়াবেটিক কন্ডিশন থাকলে বা ডায়াবেটিস হয়ে থাকলে।
- যদি আপনার ডায়াবেটিস না থাকে, তাহলে আপনার ডাক্তার আপনার বয়স এবং ঝুঁকির কারণগুলির উপর নির্ভর করে এক বা দুই বছরে অন্তত একবার রক্তের শর্করা পরীক্ষা করার পরামর্শ দিতে পারেন।
রক্তের শর্করা কমানোর ও নিয়ন্ত্রণের উপায়
- স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস।
- ফল, শাকসবজি, এবং গোটা শস্য জাতীয় খাবার খান।
- স্যাচুরেটেড ফ্যাট, ট্রান্স ফ্যাট, অতিরিক্ত লবণ ও চিনি যুক্ত খাবার এড়িয়ে চলুন।
- নিয়মিত ব্যায়াম।
- প্রতি সপ্তাহে অন্তত ১৫০ মিনিট মাঝারি-তীব্রতার অ্যারোবিক ব্যায়াম বা ৭৫ মিনিট উচ্চ-তীব্রতার এরোবিক এক্সারসাইজ করার চেষ্টা করুন।
- ওজন কমানো বা বজায় রাখা।
- ধূমপান বর্জন।
- পায়ে যত্ন নিন।
- নিয়মিত ডাক্তারের সাথে চেকআপ করান।
- চিকিৎসক প্রদত্ত ডায়াবেটিসের জন্য ওষুধ ও অন্যান্য চিকিৎসা গ্রহণ।
মনে রাখবেন
- ওজন, ব্লাড প্রেসার, কোলেস্টেরলের মাত্রা ও রক্তের শর্করা নিয়মিত পরীক্ষা করানো হার্টের সমস্যা প্রতিরোধের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উপায়।
- যদি উল্লেখিত কোনও মান বেশি থাকে, তবে সেগুলো কমানোর জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিন এবং নিয়মিতভাবে এসব মান পরীক্ষা করে তা নিয়ন্ত্রণে রাখার ব্যবস্থা করুন।
স্ট্রেস বা মানসিক চাপ কমানোর চেষ্টা
মানসিক চাপ দীর্ঘস্থায়ী হলে তা হার্টের স্বাস্থ্যের উপর বিরূপ প্রভাব ফেলে। স্ট্রেস নিয়ন্ত্রণের উপায় আয়ত্ত করলে তা আপনার হার্টের উপকার বয়ে আনবে।
- যোগব্যায়াম, ধ্যান বা স্ট্রেস ম্যানেজমেন্ট কৌশলের মাধ্যমে স্ট্রেস নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করুন।
- পর্যাপ্ত পরিমাণে ঘুমানোর চেষ্টা করুন।
- নিজের সাধ্যমতো পরিবর্তন: একেবারে অনেকগুলি পরিবর্তন একেসাথে না করে ছোট ছোট পদক্ষেপে সুস্থ জীবন শুরু করুন এবং তা বজায় রাখার উপায় খুঁজুন।
মনে রাখবেন
হার্টকে সুস্থ রাখতে আপনার জীবনযাত্রায় এই পরিবর্তনগুলি জরুরী।
আপনার হার্টের ঝুঁকি সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে আপনার ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলুন এবং সুস্থ হৃদয়ের জন্য ব্যক্তিগত পরামর্শ নিন।