লিভারের হজম শক্তি কমে গেলে কি হবে
মানবদেহের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ হলো লিভার। দেহের সঠিক কার্যকারিতার জন্য লিভারের সুস্থ থাকা অতীব জরুরি। আমাদের প্রতিদিনকার খাদ্যাভ্যাস, জীবনযাত্রা ও কিছু স্বাস্থ্যগত কারণে লিভারের হজম ক্ষমতা কমে যেতে পারে। এর ফলে নানাবিধ শারীরিক সমস্যা তৈরি হতে পারে। চলুন জেনে নেওয়া যাক লিভারের হজম শক্তি কমে যাওয়ার কারণ, লক্ষণ এবং প্রতিকার সম্পর্কে।
লিভারের কার্যাবলি
দেহের অভ্যন্তরে লিভার একজন অক্লান্ত শ্রমিকের মতো কাজ করে চলেছে। এটি আমাদের শরীরের দ্বিতীয় বৃহত্তম অঙ্গ এবং এর কার্যাবলী আমাদের সুস্থ থাকার জন্য অপরিহার্য। লিভারের প্রধান কাজগুলোর মধ্যে রয়েছে:
খাদ্য হজম করা
- লিভার অগ্ন্যাশয় থেকে নিঃসৃত বিভিন্ন এনজাইমের সহায়তায় খাদ্যের চর্বি ও প্রোটিন জাতীয় উপাদান হজমের কাজে সাহায্য করে।
- লিভার পিত্তরস উৎপাদন করে যা খাদ্যের চর্বি ভেঙে ছোট ছোট অণুতে পরিণত করে।
- লিভারে তৈরি প্রোটিন হজমকারী এনজাইমগুলো খাদ্যের প্রোটিনকে অ্যামাইনো অ্যাসিডে বিভক্ত করে।
পুষ্টি উপাদান শোষণ ও সংরক্ষণ
- লিভার খাদ্য থেকে বিভিন্ন পুষ্টি উপাদান, যেমন- গ্লুকোজ, লৌহ, ভিটামিন এ, ডি, ই, কে, ফলিক অ্যাসিড ইত্যাদি শোষণ করে।
- লিভার গ্লুকোজকে গ্লাইকোজেন হিসেবে সংরক্ষণ করে এবং প্রয়োজনের সময় রক্তে ছেড়ে দেয়।
- লিভার ভিটামিন এ, ডি, ই, কে এবং লৌহ সংরক্ষণ করে।
বিষাক্ত পদার্থ নিষ্কাশন
- লিভার আমাদের শরীরে রক্ত থেকে ক্ষতিকর ও বিষাক্ত পদার্থ (যেমন অ্যালকোহল ও অন্যান্য ওষুধের অপ্রয়োজনীয় অংশ) বের করে দিতে সাহায্য করে।
- লিভার অ্যামোনিয়াকে ইউরিয়ায় রূপান্তর করে যা কিডনির মাধ্যমে প্রস্রাবের সাথে বেরিয়ে যায়।
পিত্তরস উৎপাদন
- লিভার পিত্তরস উৎপাদন করে যা খাবার হজম করতে, বিশেষ করে চর্বি জাতীয় খাবার হজমে সাহায্য করে।
- পিত্তরস খাদ্যের চর্বিকে ভেঙে ছোট ছোট অণুতে পরিণত করে যা অন্ত্রের আবরণী দ্বারা শোষিত হতে পারে।
রক্ত তঞ্চন
- লিভারে বিভিন্ন রক্ত তঞ্চনে সহায়ক উপাদান তৈরি হয়।
- এই উপাদানগুলো রক্তক্ষরণ বন্ধ করতে সাহায্য করে।
অন্যান্য কার্যাবলী
- লিভার রক্তের কোষগুলো তৈরি ও ধ্বংস করতে সাহায্য করে।
- লিভার শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধিতে সাহায্য করে।
- লিভার দেহের হরমোনের ভারসাম্য বজায় রাখতে সাহায্য করে।
লিভারের হজম শক্তি কমে যাওয়ার কারণসমূহ
ভাইরাল হেপাটাইটিস
- হেপাটাইটিস A, B, C সহ বিভিন্ন ধরনের ভাইরাস লিভারে প্রদাহ সৃষ্টি করে।
- এই প্রদাহের ফলে লিভারের কোষগুলি ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং লিভারের কর্মক্ষমতা হ্রাস পায়।
- দীর্ঘস্থায়ী হেপাটাইটিস B এবং C লিভারের ফাইব্রোসিস এবং সিরোসিসের মতো গুরুতর জটিলতার ঝুঁকি বাড়ায়।
অ্যালকোহল সেবন
- অতিরিক্ত মদ্যপান লিভারের কোষগুলোর মারাত্মক ক্ষতিসাধন করতে পারে।
- অ্যালকোহল লিভারে চর্বি জমার কারণ হতে পারে, যা ফ্যাটি লিভার, অ্যালকোহলিক হেপাটাইটিস এবং সিরোসিসের মতো সমস্যা তৈরি করে।
- অ্যালকোহল লিভারের পুনরুৎপাদন ক্ষমতা হ্রাস করে।
অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস
- অতিরিক্ত চর্বিযুক্ত, ভাজাপোড়া, প্রক্রিয়াজাত খাবার এবং অধিক মাত্রায় চিনিজাতীয় খাদ্য গ্রহণ লিভারে চর্বি জমার কারণ হতে পারে।
- অতিরিক্ত চর্বিযুক্ত খাবার লিভারের কোষগুলোর ক্ষতি করে এবং লিভারের কর্মক্ষমতা হ্রাস করে।
- চিনিযুক্ত খাবার লিভারে চর্বি জমা এবং প্রদাহের ঝুঁকি বাড়ায়।
ওবেসিটি বা স্থূলতা
- অতিরিক্ত ওজন বা স্থূলতা লিভারের কর্মক্ষমতা ব্যাহত করতে পারে।
- স্থূলতা লিভারে চর্বি জমার ঝুঁকি অনেক বেশি।
- স্থূলতা লিভারের প্রদাহের ঝুঁকিও বাড়ায়।
কিছু ঔষধ
- প্যারাসিটামল, স্ট্যাটিনস, অ্যান্টিবায়োটিক ইত্যাদি কিছু ওষুধের দীর্ঘমেয়াদী ব্যবহার লিভারের উপর প্রভাব ফেলতে পারে।
- এই ওষুধগুলো লিভারের কোষগুলোর ক্ষতি করতে পারে।
- কিছু ওষুধ লিভারের বিষক্রিয়া বাড়াতে পারে।
অন্যান্য কারণ
- অটোইমিউন হেপাটাইটিস: এটি একটি অস্বাভাবিক রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা লিভারের কোষগুলোকে আক্রমণ করে।
- প্রোজেরিয়া: এটি একটি বিরল জিনগত রোগ যা লিভারের স্থায়ী ক্ষতি করে।
- হেমোক্রোমাটোসিস: এটি একটি জিনগত রোগ যা শরীরে অতিরিক্ত আয়রন জমা করে।
- বিলিয়ারি অ্যাট্রেসিয়া: এটি একটি জন্মগত ত্রুটি যা পিত্তনালীকে ব্লক করে।
লিভারের হজম শক্তি কমে যাওয়ার লক্ষণ
খাবারে অরুচি
- হজম শক্তি কমে যাওয়ার অন্যতম প্রধান লক্ষণ হলো খাবারে অরুচি।
- লিভার যখন সঠিকভাবে কাজ করে না, তখন খাদ্য হজম করতে এবং পুষ্টি শোষণ করতে অসুবিধা হয়।
- এর ফলে, রোগীর খাবারে আগ্রহ হারিয়ে ফেলে।
বমি বমি ভাব বা বমি হওয়া
- লিভারের সমস্যার কারণে খাদ্য হজম ঠিকমতো না হলে বমি বমি ভাব বা বমি হতে পারে।
- লিভার যখন পিত্তরস উৎপাদন করতে অক্ষম হয়, তখন চর্বিযুক্ত খাবার হজম করা কঠিন হয়ে পড়ে এবং বমি বমি ভাব হতে পারে।
- লিভারের কার্যকারিতা ব্যাহত হলে রক্তে বিষাক্ত পদার্থের মাত্রা বেড়ে যায়, যা বমি বমি ভাব বা বমির কারণ হতে পারে।
পেটে ব্যথা ও ফোলাভাব
- লিভারের সমস্যার কারণে পেটে ব্যথা ও ফোলাভাব হতে পারে।
- লিভার যখন পিত্তরস উৎপাদন করতে অক্ষম হয়, তখন পেটে গ্যাস, ফোলাভাব এবং ব্যথা হতে পারে।
- লিভারের প্রদাহের ফলেও পেটে ব্যথা ও ফোলাভাব হতে পারে।
জন্ডিস
- জন্ডিস হলো চোখের সাদা অংশ এবং ত্বক হলুদ হয়ে যাওয়া।
- লিভার যখন বিলিরুবিন নামক রঞ্জক পদার্থ সঠিকভাবে অপসারণ করতে অক্ষম হয়, তখন জন্ডিস দেখা দেয়।
- জন্ডিস লিভারের কার্যকারিতা ব্যাহত হওয়ার একটি গুরুত্বপূর্ণ লক্ষণ।
দুর্বলতা ও ক্লান্তি
- লিভারের কার্যকারিতা ব্যাহত হলে শরীরে দুর্বলভাব ও ক্লান্তি আসতে পারে।
- লিভার যখন পুষ্টি শোষণ করতে অক্ষম হয়, তখন শরীরে পর্যাপ্ত পরিমাণে শক্তি সরবরাহ করা হয় না।
- লিভারের রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিরা প্রায়শই ক্লান্তি ও দুর্বলতা অনুভব করেন।
ওজন হ্রাস
- কারণ ছাড়াই ওজন কমে যাওয়া লিভারের সমস্যার একটি লক্ষণ হতে পারে।
- লিভার যখন সঠিকভাবে কাজ করে না, তখন খাদ্য হজম করতে এবং পুষ্টি শোষণ করতে অসুবিধা হয়।
- এর ফলে, রোগীর ওজন কমে যেতে পারে।
অন্যান্য লক্ষণ
- প্রস্রাবে গাঢ় হলুদ রঙ
- মলের রঙ ফ্যাকাশে
- চুলকানি
- পেটে ফোলাভাব
- জ্বর
- ক্ষুধামান্দ্য
লিভারের হজম শক্তি কমে যাওয়ার বিভিন্ন লক্ষণ রয়েছে। উপরে উল্লেখিত লক্ষণগুলির কোনটি দেখা দিলে দ্রুত ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়া উচিত।
প্রতিকার ও চিকিৎসা: লিভারের হজম শক্তি পুনরুদ্ধারে করণীয়
স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস
- ফলমূল, শাকসবজি ও আঁশযুক্ত খাবার বেশি করে খাওয়া উচিত।ফলমূল ও শাকসবজিতে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন, খনিজ এবং অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট থাকে যা লিভারের কার্যক্ষমতা উন্নত করতে সাহায্য করে।আঁশযুক্ত খাবার হজম উন্নত করতে এবং কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করতে সাহায্য করে।
- মদ্যপান বর্জন।অ্যালকোহল লিভারের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। এটি লিভারের কোষগুলিকে ক্ষতিগ্রস্ত করে এবং লিভারের কার্যক্ষমতা হ্রাস করে।
- অতিরিক্ত তেল-মশলাযুক্ত খাবার, চিনিজাতীয় খাবার, প্রক্রিয়াজাত খাবার এড়িয়ে চলা একান্ত প্রয়োজন।এই ধরনের খাবার লিভারের উপর চাপ সৃষ্টি করে এবং লিভারের কার্যক্ষমতা হ্রাস করে।
ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখা
স্থূলতা থাকলে ওজন কমানো উচিত।অতিরিক্ত ওজন লিভারের উপর চাপ সৃষ্টি করে এবং লিভারের কার্যক্ষমতা হ্রাস করে।
নিয়মিত শরীরচর্চা
সপ্তাহে অন্তত পাঁচ দিন, প্রতিদিন ৩০ মিনিট করে হাঁটা বা অন্য কোনো ব্যায়াম করা অত্যন্ত উপকারী। নিয়মিত শরীরচর্চা লিভারের কার্যক্ষমতা উন্নত করতে এবং লিভারের কোষগুলিকে ক্ষতি থেকে রক্ষা করতে সাহায্য করে।
চিকিৎসকের পরামর্শ
উপরে উল্লেখিত লক্ষণগুলির কোনটি দেখা দিলে অবশ্যই দ্রুত চিকিৎসকের কাছে যেতে হবে।কারণটি নির্ণয় করে চিকিৎসক যথাযথ চিকিৎসা ও ওষুধের পরামর্শ দেবেন।
কিছু অতিরিক্ত টিপস
- পর্যাপ্ত পরিমাণে পানি পান করুন।
- ভিটামিন সি সমৃদ্ধ খাবার খান।
- ভালো ঘুমের অভ্যাস গড়ে তুলুন।
- মানসিক চাপ নিয়ন্ত্রণে রাখুন।
লিভারের হজম শক্তি পুনরুদ্ধারে এই টিপসগুলো অনুসরণ করলে লিভারের কার্যক্ষমতা উন্নত করতে এবং লিভারের বিভিন্ন রোগ প্রতিরোধ করতে সাহায্য করবে।
উপসংহার
লিভার দেহের জন্য একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ। খারাপ জীবনযাত্রার অভ্যাস ও অন্যান্য স্বাস্থ্যগত কারণে লিভার তার স্বাভাবিক কর্মক্ষমতা হারাতে পারে। তাই, লিভারকে সুস্থ রাখতে উপরোক্ত পরামর্শগুলো মেনে চলা খুবই জরুরি।
[অস্বীকৃতি] লেখাটি শুধুমাত্র সাধারণ তথ্য প্রদান করার উদ্দেশ্যে লেখা হয়েছে এবং এটি চিকিৎসার পরামর্শের বিকল্প নয়। কোনো নতুন খাদ্য বা সম্প্রক শুরু করার আগে সর্বদা একজন যোগ্যতাসম্পন্ন স্বাস্থ্যসেবা বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিন।