জলপাইয়ের উপকারিতা , অপকারিতা এবং খাবার নিয়ম
জলপাই গাছ মাঝারি আকারের, ১০ থেকে ১২ মিটার পর্যন্ত উঁচু হতে পারে। শীতকালে পাতা ঝরে পড়ে, ফেব্রুয়ারি-মার্চ মাসে নতুন পাতা আসে। সেই সঙ্গে আসে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সাদা ফুল।
জলপাই ফলের জন্য বিখ্যাত হলেও এর ফুলের সৌন্দর্য অসাধারণ। সারা গাছজুড়ে অসংখ্য ফুলের যে মেলা বসে, তার সৌন্দর্য উপেক্ষা করা কঠিন। গ্রীষ্মের মাঝামাঝি মলিন সাদা রঙের থোকা থোকা ফুলগুলো ফোটে। ফল খাবার উপযোগী হয় শরৎ-হেমন্তে।
তখন ফলের বাইরের আবরণ সবুজের কাছাকাছি একটি বিশেষ রঙ ধারণ করে। এ কারণে জলপাই রঙ সবার কাছে একটি বিশেষ রঙ হিসেবে পরিচিত। জলপাইয়ের গড়ন প্রায় আমড়ার মতোই। তবে আমড়ার চেয়ে আকারে ছোট। এর পাতলা আবরণের ভেতর থাকে খাবার উপযোগী শাঁস ও একটি শক্ত আঁটি বা বীজ।
জলপাই পুষ্টিগুণ
প্রতি ১০০ গ্রাম জলপাইয়ে খাদ্যশক্তি ৭০ কিলোক্যালরি, ৯ দশমিক ৭ শর্করা, ৫৯ মিলিগ্রাম ক্যালসিয়াম, ১৩ মিলিগ্রাম ভিটামিন সি।
জলপাইয়ের পুষ্টির তথ্য
পুষ্টি উপাদান | পরিমাণ (প্রতি ১০টি মাঝারি জলপাই) | দৈনিক চাহিদার শতকরা হার* |
---|---|---|
ক্যালরি | ৫৯ | – |
মোট চর্বি | ৬.৭ গ্রাম | ১০% |
স্যাচুরেটেড চর্বি | ১ গ্রাম | ৫% |
মনোস্যাচুরেটেড চর্বি | ৪.৫ গ্রাম | – |
পলিআনস্যাচুরেটেড চর্বি | ০.৫ গ্রাম | – |
সোডিয়াম | ১৫৫৬ মিলিগ্রাম | ৬৮% |
ডায়েটারি ফাইবার | ৩.৩ গ্রাম | ১৩% |
ভিটামিন ই | ১.৭ মিলিগ্রাম | ১১% |
ভিটামিন কে | ৫.১ মাইক্রোগ্রাম | ৬% |
কপার | ০.৬ মিলিগ্রাম | ৩০% |
দৈনিক চাহিদার হিসাব ২০০০ ক্যালরি খাদ্য তালিকার উপর ভিত্তি করে করা হয়েছে।
জলপাইয়ের উপকারিতা
শীতকাল জলপাইয়ের সময়। জলপাইয়ের স্বাদের জন্য অনেকেই এটা খুব পছন্দ করেন। কিন্তু আপনি জানেন কি জলপাইয়ের অসংখ্য স্বাস্থ্যগত উপকারিতা আছে
- জলপাই রক্তের অতিরিক্ত কোলেস্টেরল দূর করে।
- জলপাই রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ করে।
- জলপাইয়ে প্রচুর আঁশ বা ফাইবার রয়েছে, ফলে এটা সবজি ও ফল দুটারই কাজ করে।
- জলপাইতে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন ই রয়েছে।
- জলপাই অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট হিসাবে কোষের সুরক্ষার কাজ করে।
- ধীরে ধীরে বাড়ে এবং জটিল আকার ধারণ করে এমন রোগের প্রভাব কমায় জলপাই। যেমন আলঝেইমার বা স্মৃতিভ্রম, জটিল ধরনের টিউমার, রগ কিছুটা ফুলে যাওয়া, দাঁতের ক্যাভিটি ইত্যাদি রোগের প্রভাব কমিয়ে আনে জলপাই।
- রক্ত বেশি জমাট বাঁধা থেকে অনেক সময় মায়োকার্ডিয়াল ইনফার্কশন অথবা রক্তনালীর ভিতরে রক্তের ঘনত্ব মারাত্মকভাবে বেড়ে যেতে পারে। এই ধরনের রক্ত জমাট বাঁধা রোধ করে জলপাই।
- জলপাই ক্যান্সার বিস্তারের বিরুদ্ধে কোষের মেমব্রেনকে রক্ষা করে।
- রক্তশূন্যতা বা অ্যানেমিয়ার একটি বড় প্রতিকারের নাম জলপাই।
- জলপাই উর্বরতা বাড়ায় এবং প্রজনন প্রক্রিয়াতে কার্যকরী ভূমিকা রাখে।
- ভাইরাল অসুখ এবং অক্সিডেটিভ স্ট্রেসের বিপরীতে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে জলপাই।
- জলপাই যৌন উদ্দীপনা বাড়ায়।
- জলপাইতে প্রচুর পুষ্টিকর ও খনিজ উপাদান আছে। যেমন, সোডিয়াম, পটাসিয়াম, আয়রন, ফসফরাস এবং আয়োডিন।
- জলপাই শরীরে দরকারি ভিটামিন ও অ্যামিনো এসিড সরবরাহ করে।
- জলপাইতে অলেইক এসিড রয়েছে, আর এই অলেইক এসিড হার্টের সুরক্ষার কাজ করে।
- জলপাইতে পলিফেনল থাকে। পলিফেনল হলো এক ধরনের প্রাকৃতিক কেমিক্যাল, এটা মস্তিষ্কে অক্সিডেটিভ স্ট্রেস কমায়। প্রতিদিন নিয়মিত জলপাই খেলে আপনার স্মৃতিশক্তি শতকরা ২৫ ভাগ বাড়ার কথা।
- এক কাপ জলপাইতে প্রচুর পরিমাণে আয়রন আছে—৪.৪ মিলিগ্রাম।
- জলপাইতে অলেইক এসিড আছে। এই অলেইক এসিড ত্বককে রাখে নরম, মসৃণ ও স্বাস্থ্যকর। তাই নিয়মিত জলপাই খেলে ত্বকের বলিরেখা ২০ শতাংশ কমে যাবে।
- প্রতিদিন খাওয়ার আগে ১০ টি জলপাই খেলে আপনার ক্ষুধা ২০ শতাংশ কমে যাবে। এর কারণ হলো জলপাইতে থাকা মনোস্যাচুরেটেড ফ্যাটি এসিড হজম প্রক্রিয়া ধীরগতির করে দেয় এবং কোলেসাইটোকিনিন নামক হরমোন নিঃসরণ ঘটায়। এই হরমোন মস্তিষ্কে ক্ষুধা নিবৃত্তি বা সম্পূর্ণ হওয়ার মেসেজ পাঠায়।
- শুধু তাই নয়, জলপাই আপনার শরীরে আডিপোনেকটিন নামক রাসায়নিক পদার্থ উৎপন্ন হওয়ার পরিমাণ বাড়ায়। এই রাসায়নিক পদার্থটি খাওয়ার পাঁচ ঘণ্টা পর পর্যন্ত ফ্যাট বার্ন করে বা মেদ ঝরায়।
জলপাইয়ের অপকারিতা
জল পায়ের উপকারিতা আমরা উপর থেকে জানতে পেরেছি কারণ জলপাই একটি উপকারী ফল যা আমাদের সঠিক স্বাস্থ্য ভালো রাখতে সাহায্য করে। এবার জানবো জলপাইয়ের উপকারিতা সম্পর্কে। জলপাইয়ের অপকারিতা বলতে তেমন কিছুই নেই।
শুধু ক্ষেত্রে দেখা যায় যারা ওজন বৃদ্ধি করতে চায় তাদের ক্ষেত্রে জলপাইয়ের অপকারিতা অনেক কারণ অতিরিক্ত জলপাই খেলে শরীরের ওজন বৃদ্ধি পাওয়ার বদলে ওজন কমে যাবে। আপনাদের মধ্যে যারা ওজন বাড়াতে চান তাদের ক্ষেত্রে অতিরিক্ত জলপাই না খাওয়াই ভালো।
এছাড়াও অনেকেই আচার খেতে পছন্দ করে তবে অতিরিক্ত আচার খাওয়া ভালো নয়। এর সাথে খালি পেটে খাওয়া মোটেও ঠিক নয় তাই এসব বিষয়ে খেয়াল রেখে জলপাই উচিত।
জলপাই খাওয়ার নিয়ম
জলপাই শীতকালীন ফল এই ফলটির সার্থক তবে এর অনেক পুষ্টিগুণ রয়েছে। এই ফলটি কাঁচা অবস্থায় খাওয়া যায় এবং পেকে গেলেও খাওয়া যায়। এর পাশাপাশি ভর্তা করে আচার বানিয়ে এবং রান্না করেও খাওয়া যায় জলপাই।
তবে আপনাদের মধ্যে যারা জলপাইয়ের আচার খেতে পছন্দ করেন তারা জলপাই জলপাইয়ের আচার খাওয়ার পূর্বে অবশ্যই সকালের নাস্তা খেয়ে নিবেন। তা না হলে কিছু সমস্যা হতে পারে।
জলপাইয়ের প্রচুর উপকারিতা রয়েছে তাই শরীর স্বাস্থ্য রক্ষার ক্ষেত্রে জলপাইয়ের আচার খাওয়া বা জলপাই রান্না করে খাওয়া স্বাস্থ্যের জন্য খুবই ভালো এছাড়াও জলপাইয়ের ওষুধ হিসেবেও কাজ করে।
জলপাই পুষ্টিগুণ পাওয়ার জন্য খাদ্য তালিকায় এটি প্রতিদিন রাখা উচিত। তাই বলা যায় জলপাইয়ের উপকারিতা পাওয়ার জন্য নিয়মিত খাওয়া উচিত। উনার প্রতিদিনের খাদ্য তালিকায় জলপাই রাখুন কারণ নিয়মিত জলপাই খেলে শরীরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি পাবে।
জলপাইয়ের আচার
জলপাইয়ের স্পঞ্জ আচার
যা লাগবে
জলপাই গ্রেড করা আধা কেজি, লবণ পরিমাণমতো, চিনি পৌনে এক কাপ, মরিচ কুচি এক টেবিল চামচ, বিট লবণ এক চা চামচ, সরিষা বাটা এক টেবিল চামচ, রসুন কুচি এক টেবিল চামচ, সরিষা তেল আধা কাপ, কাসুন্দি এক টেবিল চামচ, ভিনেগার এক টেবিল চামচ।
যেভাবে করবেন
জলপাই কুচি করে কেটে নিন। পরে লবণ দিয়ে মাখিয়ে তিন থেকে চার ঘণ্টা রেখে দিন। পাতলা কাপড় দিয়ে চেপে টক পানি বের করে নিন।
এবার একটি বাটিতে জলপাই কুচি, সরিষা বাটা, বিট লবণ, রসুন কুচি, চিনি, কাঁচামরিচ কুচি, পাঁচফোড়ন সিরকা, কাসুন্দি সব একসঙ্গে মাখিয়ে কাচের পরিষ্কার জীবাণুমুক্ত বোতলে ভরে রাখুন। তৈরি হয়ে গেল মজাদার জলপাইয়ের স্পঞ্জ আচার।
জলপাইয়ের ঝাল আচার
যা লাগবে
জলপাই ১ কেজি, বোমবাই মরিচ ১০/১২ পিস, রসুন ১ কাপ, হলুদ, মরিচ, ধনে ১ চা চামচ করে, আদা ও রসুন বাটা ১ চা চামচ, সরিষা বাটা ২ টেবিল চামচ, সরিষার তেল ১ কাপ, লবণ, চিনি স্বাদমতো, পাঁচফোড়ন ২ টেবিল চামচ, সিরকা ২ টেবিল চামচ, সোডিয়াম বেনজুয়েট হাফ চা চামচ, কালোজিরা ১ চা চামচ।
যেভাবে করবেন
জলপাই সিদ্ধ করে চটকে নিন। হলুদ, মরিচ, ধনে, সরিষা বাটা, লবণ, চিনি, সিরকা, আদা ও রসুন বাটা দিয়ে পেস্ট তৈরি করে নিন। কড়াইতে সরিষার তেল দিয়ে কালোজিরা ফোড়ন দিন। পরে রসুন বোমবাই মরিচ তেলে ভাজুন।
পরে মসলা পেস্ট দিয়ে সামান্য নেড়ে কষিয়ে নিন। জলপাই চটকানো ছেড়ে নেড়ে নিন। পরে তেল ছেড়ে এলে চুলার তাপ কমিয়ে সোডিয়াম বেনজুয়েট দিয়ে নেড়ে নামিয়ে নিন। গরম অবস্থায় পরিষ্কার জীবাণুমুক্ত বোতল ভরে রাখুন। তৈরি হয়ে গেল জলপাইয়ের ঝাল আচার।
জলপাই নিয়ে কিছু সাধারণ জিজ্ঞাসা
ইতালিয়ান পদ্ধতিতে জলপাই সংরক্ষণ
জলপাই নিরাময়ের জন্য, তাদের কয়েক মাস নোনা জলের ব্রিনে বিশ্রাম নিতে হবে। নোনা জলের ব্রিনের সাথে আপনার জলপাইয়ের 3:1 অনুপাত প্রয়োজন। উদাহরণস্বরূপ, প্রতি বালতি জলপাইয়ের জন্য, আপনার এক বালতির প্রায় এক তৃতীয়াংশ ব্রিনের প্রয়োজন হবে। আপনার সমস্ত জলপাই ফিট করার জন্য যথেষ্ট বড় একটি খাদ্য-গ্রেডের পাত্র বা বালতি/গুলি খুঁজুন।
জলপাই খেলে কি ওজন কমে
জলপাইয়ে রয়েছে মোনো-স্যাচুরেটেড ফ্যাট, যা আমাদের হার্টের জন্য খুবই উপকারী। জলপাইয়ের তেলেও রয়েছে লো কোলেস্টেরল যা ওজন এবং ব্লাডপ্রেশার কমাতে সহায়ক।
কালো জলপাই ভালো নাকি সবুজ জলপাই ভালো ?
কালো জলপাই কাটার সময় পাকা হয়, আর সবুজ জলপাই অপরিষ্কার থাকে। পুষ্টির দিক থেকে: কালো জলপাইয়ের তুলনায় সবুজ জলপাইয়ে বেশি সোডিয়াম, ক্যালোরি, চর্বি এবং ভিটামিন ই থাকে । সবুজ জলপাইয়ের তুলনায় কালো জলপাইয়ে আয়রন বেশি থাকে।
ত্বকের যত্নে জলপাইয়ের তেল
ত্বকের যত্নে জলপাইয়ের তেল খুবই উপকারী। অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট, ভিটামিন ই, সি সমৃদ্ধ জলপাইয়ের তেল ত্বক ও চুলের জন্য প্রয়োজনীয় উপাদান। রূপচর্চাবিষয়ক একটি ওয়েবসাইটে প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে ত্বকের যত্নে জলপাইয়ের তেলের উপকারিতা সম্পর্কে জানানো হল।
- জলপাইয়ের তেল এসেনশিয়াল ফ্যাটি অ্যাসিড সমৃদ্ধ। যা ত্বক কোমল ও মসৃণ করে আর্দ্রতা রক্ষা করে। এছাড়া রক্ত সঞ্চালনই বাড়ায় না পাশাপাশি ত্বক সুস্থ ও সুন্দর রাখতেও সহায়তা করে।
- এই তেল ত্বক পরিষ্কার করে। ত্বকে জলপাইয়ের তেল মালিশ করলে তা লোমকূপে প্রবেশ করে ময়লা পরিষ্কার হয়। তাই মুখ পরিষ্কারের আগে জলপাইয়ের তেল মালিশ করে নিতে পারেন।
- মেকআপ তুলতে জলপাইয়ের তেল ব্যবহার করতে পারেন। এই তেল ত্বক কোমল রাখে ও ময়লা দূর করতে সাহায্য করে।