মিষ্টিকুমড়ার উপকারিতা, অপকারিতা এবং পুষ্টিগুণ
মিষ্টিকুমড়া দেখতে যেমন মোটাসোটা নাদুসনুদুস, এর পুষ্টিগুণও তেমনি ব্যাপক। আসলে অ্যান্টি অক্সিডেন্ট ভিটামিনের একটি ভান্ডার এই কুমড়া।
এসব গুণাগুণের কথা না জেনেই তরকারি হিসেবে কুমড়া অনেকেরই পছন্দ। আর এই সবজির গুণের তালিকা জানা থাকলে পছন্দের মাত্রা নিশ্চয় আরও বেড়ে যাবে।
মিষ্টি কুমড়া আমাদের দেশে পরিচিত একটি সবজি। এটি দেখতে যতটা সুন্দর, এর উপকারিতাও ততটাই বেশি। ভাজা, ভাজি, ভর্তা কিংবা ঝোল করে তো খাওয়া যায়ই, মিষ্টি কুমড়া দিয়ে তৈরি করা যায় সুস্বাদু হালুয়া। আপনি যদি মিষ্টি কুমড়া খেতে পছন্দ না করেন, তবে আপনি অনেক স্বাস্থ্যোপকারিতা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।
কুমড়ার পুষ্টিগুণ
এতে আছে ভিটামিন এ, ভিটামিন সি, ভিটামিন ই আলফা টোকোফেরল, থায়ামিন, নিয়াসিন, ভিটামিন বি৬, আয়রন, পটাসিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম, ফসফরাস ও উচ্চমাত্রার খাদ্য আঁশ।স্বাস্থ্য-সুবিধা: অ্যান্টি অক্সিডেন্ট ভিটামিন এ, ভিটামিন সি, ভিটামিন ই শরীর ও ত্বকের জন্য উপকারী হিসেবে কাজ করে।
বিভিন্ন ধরনের ক্যানসারের ঝুঁকি কমায় এবং হূদেরাগ থেকে প্রতিরক্ষা দেয়। আর কুমড়ার পটাসিয়াম উচ্চ রক্তচাপের ঝুঁকি হ্রাস করে এবং রোগ প্রতিরোধক্ষমতা বাড়ায়। শরীরের ওজন কমাতেও সহযোগিতা করে এটি। খাদ্য আঁশের অন্যতম উৎস কুমড়ার বিচি। এটি হূৎস্বাস্থ্যের জন্যও খুবই উপকারী। কুমড়ার বিচি ভেজেও খাওয়া যায়।
মিষ্টিকুমড়ার পুষ্টিগুণ এবং আমাদের দৈনিক চাহিদা পূরণের শতকরা হার সম্পর্কে একটি সারণি তৈরি করা হলো:
মিষ্টিকুমড়ার পুষ্টিকর উপাদান এবং দৈনিক চাহিদা পূরণের হার
পুষ্টি উপাদান | প্রতি ১০০ গ্রাম মিষ্টিকুমড়ায় পরিমাণ | দৈনিক চাহিদার শতকরা হার* |
---|---|---|
ভিটামিন এ | ১৭,০০০ আই.ইউ | ৩৪০% |
ভিটামিন সি | ৯.৫ মিলিগ্রাম | ১৬% |
ডায়েটারি ফাইবার | ৩ গ্রাম | ১২% |
পটাশিয়াম | ৫৬৪ মিলিগ্রাম | ১৬% |
ম্যাঙ্গানিজ | ০.২৫ মিলিগ্রাম | ১১% |
দৈনিক চাহিদার শতকরা হার একজন প্রাপ্তবয়স্কের গড় প্রয়োজনের উপর ভিত্তি করে তৈরি করা হয়েছে।

মিষ্টিকুমড়ার গুরুত্ব:
- ভিটামিন এ এর উৎস: মিষ্টিকুমড়া ভিটামিন এ এর চমৎকার উৎস, যা চোখের স্বাস্থ্য, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা এবং ত্বকের সুস্থতার জন্য জরুরী।
- অ্যান্টিঅক্সিডেন্টগুণ: মিষ্টিকুমড়ায় রয়েছে প্রচুর অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট যা আমাদের কোষগুলিকে ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা করে।
- ফাইবার সমৃদ্ধ: মিষ্টিকুমড়াতে থাকা ফাইবার হজমশক্তির উন্নতি এবং রক্তে শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে।
মিষ্টি কুমড়া উপকারিতা
পুষ্টিগুণে ভরপুর সবজিগুলোর মধ্যে অন্যতম মিষ্টি কুমড়া। নিয়মিত মিষ্টি কুমড়া খেলে শরীরের পাশাপাশি ভালো থাকে ত্বক চুল। জেনে নিন মিষ্টি কুমড়ার উপকারিতা সম্পর্কে।
চুল ও ত্বক ভালো রাখে
একটি মিষ্টি কুমড়াতে থাকে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন-সি। যা আমাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়িয়ে তুলে সর্দি-কাশি, ঠান্ডা লাগা প্রতিরোধ করতে সাহায্য করে।
ভিটামিন এ এবং সি
মিষ্টি কুমড়ার ভিটামিন এ ও সি চুল ও ত্বক ভালো রাখে। তাই চকচকে উজ্জ্বল চুল ও সুন্দর ত্বকের জন্য নিয়মিত মিষ্টি কুমড়া খেতে পারেন।
রেডিকাল ড্যামেজ প্রতিরোধ করে
মিষ্টি কুমড়াতে রয়েছে বিটাক্যারোটিন। বিটাক্যারোটিন এক ধরনের শক্তিশালী অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট। শরীরের ফ্রি রেডিকাল ড্যামেজ প্রতিরোধে মিষ্টি কুমড়া ভূমিকা পালন করে।
বিভিন্ন দূষণ, স্ট্রেস ও খাবারে যেসব কেমিক্যাল ও ক্ষতিকর উপাদান থাকে সেগুলোর কারণে ফ্রি রেডিকাল ড্যামেজ হতে শুরু করে।
ফ্রি রেডিকাল ড্যামেজের ফলে শরীরের ভালো কোষগুলো নষ্ট হতে শুরু করে এবং খারাপ কোষের সংখ্যা বাড়তে শুরু করে। সবুজ, কমলা, হলুদ রঙের সবজিতে অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট বেশি পরিমাণে থাকে। তাই মিষ্টি কুমড়া ফ্রি রেডিকাল ড্যামেজ প্রতিরোধ করতে পারে।
গর্ভবতী মায়েদের জন্য
মিষ্টি কুমড়া ও এর বীজ গর্ভবতী মায়েরা তাদের অনাগত সন্তানের সুস্বাস্থ্যর জন্য নির্দ্বিধায় খেতে পারেন। মিষ্টি কুমড়া গর্ভবতী মায়েদের রক্তস্বল্পতা রোধ করে অকাল প্রসবের সম্ভাবনা কমিয়ে দেয়।
চোখের যত্নে
এককাপ পরিমাণ রান্না করা মিষ্টি কুমড়া আমাদের চোখের সুস্বাস্থ্য রক্ষা করতে অন্যান্য খাবার থেকে ১০০ গুণ বেশি কাজ করে।
বিটা-ক্যারোটিন ও আলফা-ক্যারোটিন মত ক্যারটিনয়েড সমূহ চোখের ছানি পড়া রোধ সহ চোখের রেটিনা কোষ রক্ষা করে। তাই চোখকে সচল ও সুস্থ রাখতে আপনার খাদ্য তালিকায় মিষ্টি কুমড়া যোগ করুন।
ওজন কমাতে
কম ক্যালোরি এবং উচ্চ ফাইবারযুক্ত খাবার মিষ্টি কুমড়া ওজন কমাতে একটি উপযুক্ত খাবার। এছাড়া মিষ্টি কুমড়ার উচ্চ পটাসিয়াম কন্টেন্টও খুব সুন্দরভাবে আপনার শরীরের বাড়তি মেদটুকু সযত্নে ঝড়িয়ে দিতে সাহায্য করে। যার ফলে আপনি হার্টের রোগ বা কিডনির রোগ থেকে সুস্থ থাকবেন।
যারা তাদের শরীরের অতিরিক্ত ওজন নিয়ে বিব্রত তারা নিঃসন্দেহে কুমড়া খেতে পারেন।
কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করে
মিষ্টি কুমড়ায় প্রচুর পরিমাণে আঁশ থাকায় তা সহজেই হজম করতে সাহায্য করে। হজমশক্তি বৃদ্ধি ও কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করতে মিষ্টি কুমড়ার জুড়ি নেই।
বয়সের ছাপ পড়তে দেয় না
মিষ্টি কুমড়াতে আছে প্রচুর পরিমাণে জিংক ও আলফা হাইড্রোক্সাইড। জিংক ইমিউনিটি সিস্টেম ভালো রাখে ও অস্টিওপোরোসিস প্রতিরোধ করতে সাহায্য করে।
এছাড়া বয়সের ছাপ প্রতিরোধ করতেও মিষ্টি কুমড়া সাহায্য করে।

মিষ্টি কুমড়ার বিচির উপকারিতা
মিষ্টি কুমড়ার বিচি আমরা সবজির আবর্জনা হিসেবে ফেলে দেই। অথচ এটি আমাদের শরীরের জন্য ভীষণ উপকারী। এটি এন্টি অক্সিডেন্ট এবং অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ পুষ্টি উপাদানে ভরপুর। কিছু কিছু ক্যান্সারের ঝুঁকি কমাতে এর ভূমিকা অপরিসীম। প্রোস্টেড এবং ব্লাডারের স্বাস্থ্য রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
এতে ১০০গ্রামে প্রোটিন আছে ২৯.৮৪ গ্রাম, যা আমরা এক টুকরো ১০০গ্রাম মুরগীর মাংসে পেয়ে থাকি। অর্থাৎ উৎকৃষ্ট মানের এবং যথেষ্ট পরিমাণ প্রোটিন পেতে কম খরচে এটি একটি সহজলভ্য খাবার।
মিষ্টি কুমড়ার বিচি কিভাবে খাবেন
সাধারণত পাকা মিষ্টি কুমড়ার বিচিই খাওয়ার জন্য উৎকৃষ্ট। মিষ্টি কুমড়ার বিচি সংগ্রহ করে ভালোভাবে ধুয়ে শুকনো করে তাওয়া বা ফ্রাই প্যানে টেলে মচমচে করে ভেজে অবশ্যই তেল ছাড়া কাচের বয়ামে সংরক্ষণ করা যায়। প্রতিদিন শুধুমাত্র ভাজা বিচি চিবিয়ে, মিক্সড ফলের সাথে অথবা সালাদে যোগ করে খাওয়া যায়।
অনেকক্ষেত্রে ব্লেন্ডারে গুড়ো করে বিভিন্ন ভর্তায় মিশিয়ে, স্যুপে মিশিয়ে অথবা সরাসরি ভর্তা বানিয়ে, সবজি রান্নায় ও মিশিয়ে খাওয়া যায় এবং শিশুদের ক্ষেত্রে তাদের খিচুড়ি বা অন্য তরল খাবারে মিশিয়ে বাড়তি পুষ্টি সরবরাহ নিশ্চিত করা যায়।
মিষ্টি কুমড়ার জুসের উপকারিতা
মিষ্টি কুমড়া ওজন কমাতে সাহায্য করে। বিশেষ করে এর তৈরি জুস বা রস ওজন কমাতে কার্যকরী ভূমিকা রাখে।এটি তৈরির পদ্ধতিও বেশ সহজ। মিষ্টি কুমড়া ছোট ছোট টুকরা করে কেটে ব্লেন্ডারে দিন। সামান্য পানি দিন।
এখন এতে পরিমাণ মতো চিনি মিশিয়ে খেতে পারেন। তবে চিনির পরিবর্তে মধু খেলে এটি বেশি কার্যকর হবে
মিষ্টি কুমড়ায় খুব কম পরিমাণে ক্যালরি রয়েছে। ১০০ গ্রাম মিষ্টি কুমড়ায় ক্যালরি পাওয়া যাবে মাত্র ২৬। মিষ্টি কুমড়ার জুস খেলে তা শরীরে বাড়তি ক্যালরি জমা হতে বাঁধা দেয়।
সাধারণত ব্যায়ামের পরে মিষ্টি কুমড়ার জুস খেলে তা দারুণ কাজ করে। এটি হজমে সহায়তা করে। সেই সঙ্গে কোষ্টকাঠিন্য কমায়।
মিষ্টি কুমড়ার জুসে থাকা ভিটামিন সি ও বিটা ক্যারোটিন যেকোনো ধরনের প্রদাহ কমায় যা ওজন কমাতে ভূমিকা রাখে। এছাড়া এতে থাকা ভিটামিন সি যেকোনো ধরনের সংক্রমণও কমায়।
মিষ্টি কুমড়ার জুস ভালো ঘুম হতে সাহায্য করে। রাতে ঘুমানোর আগে মিষ্টি কুমড়ার জুসের সঙ্গে যদি মধু মিশিয়ে খাওয়া যায় তাহলে তা ভালো ঘুমের সহায়ক হিসেবে কাজ করে।
মিষ্টি কুমড়ার ভর্তা
৩০০ গ্রাম মিষ্টি কুমড়া ছোট টুকরা করে কেটে নিন। চুলায় একটি প্যান বসিয়ে ১ টেবিল চামচ তেল গরম করে মিষ্টি কুমড়ার টুকরোগুলো দিয়ে দিন। অল্প লবণ ছড়িয়ে দিয়ে প্যান ঢেকে সেদ্ধ করুন মাঝারি আঁচে। কিছুক্ষণ পর উল্টে দিন। ঢাকনা খুলে রেখে নেড়েচেড়ে দিন। পোড়া দাগ হয়ে গেলে নামিয়ে নিন।
প্যানে কয়েকটি শুকনা মরিচ টেলে নিন। মচমচে হয়ে গেলে নামিয়ে লবণ দিয়ে ভেঙে নিন। পেঁয়াজ কুচি, সরিষার তেল ও ধনেপাতা কুচি দিয়ে মেখে মিষ্টি কুমড়ার টুকরোগুলো মেখে নিন। পরিবেশন করুন গরম ভাতের সঙ্গে।
মিষ্টি কুমড়ার অপকারিতা
মিষ্টি কুমড়ার অপকারিতা এর উপকারিতার তুলনায় বেশ কম তাও এর কিছু অপকারিতা রয়েছে।
- সীমিত পরিমাণে খাওয়া হলেই মিষ্টি কুমড়ার উপকারিতা পাওয়া যায় কিন্তু বেশি পরিমানে খেলে অপকার হতে পারে। মিষ্টি কুমড়ার খাওয়াতে উপকারিতা থেকে অপকারিতা অনেক কম। চলুন আমরা মিষ্টি কুমড়া খাওয়ার অপকারিতাগুলো জেনে আসি।
- মিষ্টি কুমড়াতে ভিটামিন-এ এর একটি ভাল উৎস। এই উপকারী ভিটামিনের পরিমাণ শরীরে অতিরিক্ত হলে গর্ভাবস্থায় মায়ের সমস্যা ও অনাগত সন্তানের জন্মগত ত্রুটি দেখা দিতে পারে।
- এটি বেশি খেলে অ্যালার্জি হতে পারে এছাড়া বেশি কুমড়ো খাওয়ার পর গ্যাস বা পেট ফাঁপা হওয়ার মতো উপসর্গ অনুভূত হয়, তাহলে এ বিষয়ে চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।

মিষ্টি কুমড়া চাষ
শীত মৌসুমে মিষ্টি কুমড়া চাষ করতে চাইলে অক্টোবর – ডিসেম্বর মাস পর্যন্ত বীজ বপন করা উত্তম। আর গ্রীষ্মকালে এই বর্ষজীবী সবজির চাষবাদ করতে চাইলে ফেব্রুয়ারি – মার্চ মাস পর্যন্ত বীজ বোনার উপযুক্ত সময়।
উন্নত ফলন পেতে হলে নভেম্বর মাসের মাঝামাঝি সময়ে বীজ বোনা উচিত। মিষ্টি কুমড়ার চাষের জন্য উষ্ণ ও আর্দ্র জলবায়ু প্রয়োজন।
কুমড়া সংরক্ষন
ঠান্ডা ও বাতাস চলাচল করা জায়গাতে ফল ঘষা বা চাপ খায় না এমন ভাবে সংরক্ষণ করুন। বীজ বেশিদিন সংরক্ষণ করতে চাইলে নিমের তেল মিশিয়ে রাখতে পারেন। কিছুদিন পর পর বীজ হালকা রোদে শুকিয়ে নিবেন।