বরবটির উপকারিতা, অপকারিতা, পুষ্টিগুণ এবং কিছু সহজ রেসিপি
বরবটি এটি এক প্রকার সবজি। বাংলাদেশের একটি জনপ্রিয় সবজি। সারা বছরই এই সবজি চাষ করা যায়। রান্না করে খাওয়ার পাশাপাশি এটি কাঁচাও খাওয়া যায়। এই সবজি প্রোটিনসমৃদ্ধ।
বরবটি বসতবাড়িতেও চাষ করা যায়। ভাজা-সেদ্ধ-তরকারি সবকিছুতেই সমান উপযোগী। পুষ্টিগুণেও সমৃদ্ধ। সাধারণত সেদ্ধ, ভাজা বা ঝোল রান্না করে খাওয়া হয়।
বরবটি পুষ্টিগুণ
১০০ গ্রাম বরবটিতে রয়েছে জলীয় অংশ ৮৭.৫ গ্রাম, প্রোটিন ৩.০ গ্রাম, শর্করা ৯.০ গ্রাম, মোট খনিজ পদার্থ ০.৮ গ্রাম, ক্যালসিয়াম ৩৩ মিলিগ্রাম, আয়রন ৫.৯, ভিটামিন বি-১ ০.১৪, ভিটামিন বি- ২ ০.৩০ মিলিগ্রাম, ভিটামিন সি খুব অল্প, খাদ্যশক্তি ১৮ ক্যালরি।
আছে প্রচুর পরিমাণে অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট, অ্যান্টিভাইরাল , অ্যান্টিব্যাকটিরিয়াল, অ্যান্টিক্যান্সার ধর্ম। এতে আরও রয়েছে ভিটামিন বি১ , বি ২, ক্লোরোফিল , রিবোফ্লাভিন , ফসফরাস, থায়ামিন , তন্তু ও বিভিন্ন খনিজ পদার্থ।
১০০ গ্রাম রান্না করা বরবটিতে পাওয়া পুষ্টি উপাদান (আনুমানিক) এবং দৈনিক চাহিদা পূরণের শতাংশ (আনুমানিক)
পুষ্টি উপাদান | পরিমাণ (আনুমানিক) | দৈনিক চাহিদা পূরণের শতাংশ (আনুমানিক)* |
---|---|---|
ক্যালোরি | ৪৭ | ২.৩৫% |
মোট কার্বোহাইড্রেট | ৯ গ্রাম | ৩% |
ফাইবার | ৩.৬ গ্রাম | ১৪.৪% |
চিনি | ২.৮ গ্রাম | নগণ্য (nagônyo) |
প্রোটিন | ২.৮ গ্রাম | ৫.৬% |
ভিটামিন সি | ১৮ মিলিগ্রাম | ২৪% |
ভিটামিন এ | ৪০০ আইইউ | ৮% |
ভিটামিন কে | ৪০ মাইক্রোগ্রাম | ৫০% |
ফোলেট | ৬২ মাইক্রোগ্রাম | ১৫.৫% |
পটাশিয়াম | ২৫০ মিলিগ্রাম | ৫.৩২% |
*একটি ২০০০ ক্যালোরির ডায়েট এবং গড় প্রাপ্তবয়স্কদের চাহিদার উপর ভিত্তি করে।

গুরুত্বপূর্ণ বিষয়সমূহ:
- কম ক্যালোরিযুক্ত, ফাইবার সমৃদ্ধ: বরবটি কম ক্যালোরিযুক্ত এবং পরিমাণমতো ফাইবার সরবরাহ করে।
- ভিটামিনের উৎস: এগুলো কিছু ভিটামিন সি, ভিটামিন এ, ভিটামিন কে এবং ফোলেট (ভিটামিন বি ৯) সরবরাহ করে।
- খনিজ উপস্থিত: বরবটিতে কম পরিমাণে বিভিন্ন খনিজ যেমন পটাশিয়াম এবং ম্যাগনেসিয়াম থাকে।
- রান্না করা গুরুত্বপূর্ণ: আপনি বরবটি যেভাবে রান্না করবেন তা পুষ্টি উপাদানের উপর সামান্য প্রভাব ফেলতে পারে।
বরবটি উপকারিতা
ক্যাম্পফেরল ও কুয়ারসেটিন নামক ফ্ল্যাভোনয়েড উপাদান সমৃদ্ধ সবজি বরবটি কাজ করে অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট হিসাবে। এ উপাদান দুটো ক্যানসারের কোষ বৃদ্ধি রোধে চমৎকার কাজ করে।
বরবটি সবজির মধ্যে যে সবচেয়ে লম্বা তাতে কোন সন্দেহ নেই। জেনে নিন বরবটির নানা পুষ্টিগুণ –
হার্টের সুরক্ষায় বরবটি
শরীরের ক্ষতিকর কলেস্টেরলের পরিমাণ কমিয়ে দেয় বরবটি। ফলে হার্টের সুরক্ষা নিশ্চিত হয়।
এছাড়া এটি উচ্চ রক্তচাপ, বুক জ্বালাপোড়া প্রভৃতি সমস্যা দূর করতেও ভূমিকা রাখে। তাই পরিমাণ মতো বরবটি খাওয়া মোটেই মন্দ নয়।
ক্যান্সারের সম্ভাবনা কমায়
বরবটিতে ফ্ল্যাভোনয়েড নামে অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট রয়েছে। এর দুটি উপাদান ক্যাম্পফেরল ও কুয়ারসেটিন ক্যান্সার হওয়ার সম্ভাবনা একেবারেই কমিয়ে আনে। গবেষণায় দেখা গেছে, এই দুই উপাদান ক্যান্সার কোষের বৃদ্ধি রোধে চমৎকার কাজ করে।
ডায়াবেটিস থেকে বাঁচায়
ডায়াবেটিসের হাত থেকে রক্ষা করতেও বরবটির ভূমিকা অনেক। একইসঙ্গে চুল পড়ে যাওয়া ঠেকাতেও ভূমিকা রয়েছে বরবটির।
হাড়ের ঘনত্ব বৃদ্ধিতে
সিলিকন বিদ্যমান থাকায় বরবটি হাড়ের ঘনত্ব বৃদ্ধি করে। এছাড়া হাড় শক্ত করতে প্রয়োজনীয় ক্যালিসিয়ামও পাওয়া যায় বরবটির বীজে। বরবটির খারাপ দিক খুব কম। নেই বললেই চলে।
তবে যাদের রক্তে চিনি অনেক বেশি তাদের বারবার না খাওয়াই ভালো। অন্যদিকে যাদের কিডনিতে ক্রিয়েটিনিনের সমস্যা এবং যাদের গেঁটে বাত আছে তাদের বরবটি পরিহার করাই উচিত।
অস্থিসন্ধির ব্যথা কমায়
সালাদের বাটিতে প্রতিদিন ২৫০ মিলিগ্রাম কাঁচা বরবটি মিশিয়ে নিন। এতে আপনি আপনার প্রতিদিনের ভিটামিন ‘কে’-এর ১৯ শতাংশ মেটাতে পারেন।
ভিটামিন কে অস্টিওআর্থারাইটিস সমস্যা থেকে অস্থিসন্ধির যত্ন নেবে। আর রক্ত জমাট বাঁধতে ভিটামিন কে- এর ভূমিকার অপরিসীম।
আয়রনের ঘাটতি মেটায়
ভিটামিন সি শরীরের জন্য প্রয়োজনীয় আয়রন পরিশোষণে ভূমিকা রাখে। সালাদে কাঁচা বরবটি খেলে তা থেকে প্রচুর ভিটামিন সি পাওয়া যায়।
তাছাড়া বরবটিতেও রয়েছে যথেষ্ট পরিমাণ আয়রন। যা আপনার শরীরের আয়রনের ঘাটতি পূরণে সাহায্য করে।
চর্বি কমাতে সাহায্য করে
বরবটিতে প্রচুর পরিমাণে অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট রয়েছে, যা শরীর থেকে দূষিত যৌগগুলোকে বের করে দেয়। ফলে সহজে শরীরে চর্বি জমতে পারে না।
এছাড়া কম ক্যালরিযুক্ত খাদ্য ও ফ্যাট-কলেস্টেরল না থাকায় এটি পেট ভরে খাওয়াও যায়। এতে করে ক্ষুধাভাব কম হয়।

বরবটির অপকারিতা
উপকারিতার পাশাপাশি বরবটির রয়েছে বেশ কিছু অপকারিতা। চলুন জেনে নেওয়া যাক
- অতিরিক্ত বরবটি খেলে শরীরের গ্যাট্রিকের সমস্যা দেখা দিতে পারে।
- আমাদের শরীরে কোলেস্টরল লেভেল একদম কমিয়ে ফেলে যা স্বাস্থ্যের জন্য হানিকারক।

বরবটি চাষ পদ্ধতি
দোআঁশ ও বেলে দোআঁশ মাটি বরবটি চাষের জন্য উপযোগী। বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ মাসে সাধারণত বীজবপন করা হয়। তাছাড়া আশ্বিন-অগ্রাহায়ণ মাসেও বীপবপন কর হয়। অন্যান্য সময়ও বোনা যেতে পারে। প্রতি শতকে ১০০-১২৫ গ্রাম, হেক্টর প্রতি ৮-১০ কেজি।
গোবর, টিএসপি সম্পূর্ণ পরিমাণ ও অর্ধেক এমওপি সার শেষ চাষের সময় জমিতে প্রয়োগ করতে হয়। পরে বীজ বোনার ২০ দিন পর ১০০ গ্রাম ইউরিয়া ও বাকি অর্ধেক এমওপি সার জমিতে উপরি প্রয়োগ করতে হবে।
২ মিটার দূরত্বে সারি করে ২৫-৩০ সেমি. দূরে দূরে বীজ বুনতে হয়। জাত হিসেবে সারির দূরত্ব ১ মিটার বাড়ানো বা কমানো যায়। চারা বড় হলে মাচা বা বাউনি দিতে হবে।
জমিতে পানির যাতে অভাব না হয় সে জন্য প্রয়োজন অনুসারে সবসময় সেচ দিতে হবে। আগাছা পরিষ্কার রাখতে হবে। পোকামাকড় ও রোগ ব্যবস্থাপনা শিমের মতই।
জাব পোকা, ফল ছিদ্রকারী পোকা ও মোজেইক রোগ বরবটি চাষের বড় সমস্যা। বীজ বোনার ৫০ – ৬০ দিন পর থেকেই বরবটি সংগ্রহ করা যায়। শতক প্রতি ফলন ৩০ – ৬০ কেজি, হেক্টর প্রতি১০ – ১২ টন।
বরবটির রেসিপি
বরবটি-আলুর তরকারি রান্নার উপকরণ
- বরবটি
- আলু
- গোটা জিরে
- পেঁয়াজ কুচি
- রসুন কুচি
- হলুদ গুঁড়ো
- লঙ্কার গুঁড়ো
- জিরে গুঁড়ো
- ধনে গুঁড়ো
- কাশ্মীরি লঙ্কার গুঁড়ো
- টমেটো কুচি
- নুন
- চিনি
- গোলমরিচ গুঁড়ো
- গরম মসলার গুঁড়ো
- সরষের তেল
প্রনালী
প্রথমেই বরবটি গুলোকে ধুঁয়ে টুকরো টুকরো করে কেটে নিতে হবে। এরপর ২ টো আলুর খোসা ছাড়িয়ে ধুঁয়ে পিস পিস করে কেটে নিতে হবে।
তারপর গ্যাসে কিছুটা জল গরম করে বরবটি দিয়ে ভাপিয়ে নিয়ে জল ঝরিয়ে নিতে হবে। এরপর কড়াইতে ৩ টেবিল চামচ সরষের তেল গরম করে ১/২ চামচ গোটা জিরে ফোড়ন দিয়ে রসুন কুচি দিয়ে নাড়াচাড়া করে নিতে হবে।
পেঁয়াজ কুচি দিয়ে নাড়াচাড়া করতে হবে। তারপর আলু দিয়ে আবারও ভালো করে ভাজা ভাজা করে নিতে হবে। এরপর হলুদ গুঁড়ো, লঙ্কার গুঁড়ো, জিরে গুঁড়ো, ধনে গুঁড়ো, কাশ্মীরি লঙ্কার গুঁড়ো দিয়ে নারচার করে জল দিয়ে কিছুক্ষণ কষিয়ে নিতে হবে।
তারপর বরবটি স্বাদমতো নুন, চিনি দিয়ে ভালো করে কষিয়ে নিতে হবে। এরপর টমেটো কুচি দিয়ে আবারও একবার মিশিয়ে ঢাকনা বন্ধ করে ৬-৭ মিনিট রান্না করে নিতে হবে।
তারপর ১/৪ চা চামচ গোলমরিচ গুঁড়ো, ১/২ চা চামচ গরম মসলার গুঁড়ো দিয়ে ভালো করে মিশিয়ে মিনিট পাঁচেক রান্না করে নিলেই একেবারে তৈরি আলু-বরবটির তরকারি।
বরবটির ভর্তা
উপকরন
বরবটি টুকরা করা ১/২ কাপ
চিংড়ি মাছ ১/৪ কাপ
পেঁয়াজ মোটা কুঁচি ৩ টেবিল চামচ
রসুন ৩ কোয়া
লবন পরিমানমত
ধনিয়া পাতা কুঁচি ২ টেবিল চামচ
কাঁচা মরিচা ২টি/ঝাল অনুযায়ী পরিমানমত
সরিষার তেল ১ টেবিল চামচ
নির্দেশনা
প্রথমে প্যানে তেল দিয়ে চিংড়ি মাছ ভেজে নিন। ঐ একই প্যানে বরবটি, পেঁয়াজ, রসুন, ধনিয়া পাতা এবং মরিচ হালকা আঁচে বেশ সময় নিয়ে টেলে নিন।
বরবটি, পেঁয়াজ, রসুন এবং মরিচ সিদ্ধ হয়ে গায়ে হালকা পোড়া পোড়া দাগ হলে চুলা থেকে নামিয়ে ঠাণ্ডা করে নিন। এখন চিংড়ি মাছ সহ সব একসাথে পাটায় বেটে নিন। প্রয়োজন মত লবন দিন। তৈরি বরবটির ভর্তা।