রক্তদানের উপকারিতা, নিয়ম এবং শর্ত
স্বেচ্ছায় নিজের রক্ত অন্য কারো প্রয়োজনে দান করাই রক্তদান। তবে রক্তদাতাকে অবশ্যই পূর্ণবয়স্ক অর্থাৎ ১৮ বছর বয়স হতে হয়। প্রতি তিন মাস অন্তর প্রত্যেক সুস্থ ও প্রাপ্তবয়স্ক নর-নারী নিশ্চিন্তে ও নিরাপদে রক্তদান করতে পারেন। এতে স্বাস্থ্যে কোনো ধরনের ক্ষতিকর প্রভাব পড়ে না।
রক্তের প্রয়োজনে মানুষের পাশে দাঁড়াতে হয় মানুষকেই। রক্তদান নিঃসন্দেহে মহৎ ও মানবিক। তবে এর সাথে নানান জটিল দুরারোগ্য ব্যাধী থেকে বাঁচার উপায়ও হলো নিয়মিত রক্তদান। যেমন, ক্যান্সার। হ্যাঁ, নিয়মিত রক্তদান যে ক্যান্সারের ঝুঁকি কমায় তা বৈজ্ঞানিকভাবে পরীক্ষিত।
রক্ত দেওয়া নিয়ে অনেকের মনে ভীতি ও ভ্রান্ত ধারণা আছে। রক্ত দিলে শরীরের কোনো ক্ষতি হয় না। শরীর শুকিয়ে যায় না বা শক্তিও নিঃশেষ হয়ে যায় না। বরং রক্তদানের নানাবিধ উপকার আছে। রক্তদানের মাধ্যমে আপনি অন্যের জীবন বাঁচাতে ভূমিকা রাখতে পারেন। গবেষণা বলছে,
নিয়মিত রক্তদানের ফলে কিছু ক্যানসারের ঝুঁকি কমে। রক্ত দেওয়ার ফলে অস্থিমজ্জার রক্তকণিকা উৎপাদন ব্যবস্থা আরও সক্রিয় হয় ও নতুন লোহিত রক্তকণিকা তৈরির হার বাড়ে। যাদের রক্তে আয়রন জমার প্রবণতা আছে, রক্তদান তাদের জন্য ভালো।
রক্তদানের উপকারিতা
তবে রক্তদানের পদ্ধতি ও পরবর্তী প্রভাব সম্পর্কে অজ্ঞতা ও অযথা ভীতির কারণে অনেকেই রক্ত দিতে দ্বিধান্বিত হন। কিন্তু রক্তদানেরও যে উপকারিতা রয়েছে
- রক্তদানে কোনো সমস্যা হয় না। কেননা একজন সুস্থ মানুষের শরীরে পাঁচ-ছয় লিটার রক্ত থাকে। এর মধ্যে সাধারণত ২৫০ থেকে ৪০০ মিলিলিটার রক্ত দান করা হয়, যা শরীরে থাকা মোট রক্তের মাত্র ১০ ভাগের এক ভাগ। রক্তের মূল উপাদান পানি, যা ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই পূরণ হয়।
- রক্তদান স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী। রক্তদানের সঙ্গে সঙ্গে শরীরের ‘বোনম্যারো’ নতুন কণিকা তৈরির জন্য উদ্দীপ্ত হয়। দুই সপ্তাহের মধ্যে নতুন রক্তকণিকা জন্ম হয়, ঘাটতি পূরণ হয়।
- বছরে তিনবার রক্তদান শরীরে লোহিত কণিকাগুলোর প্রাণবন্ততা বাড়িয়ে তোলে ও নতুন কণিকা তৈরির হার বাড়ায়।
- নিয়মিত রক্তদানকারীর হার্ট ও লিভার ভালো থাকে।
- স্বেচ্ছায় রক্তদানের মাধ্যমে পাঁচটি পরীক্ষা সম্পূর্ণ বিনা খরচে করা হয়। এর মাধ্যমে জানা যায় শরীরে অন্য বড় কোনো রোগ আছে কি না। যেমন—হেপাটাইটিস-বি, হেপাটাইটিস-সি, ম্যালেরিয়া, সিফিলিস, এইচআইভি এইডস ইত্যাদি।
- রক্তদান অনেক ক্ষেত্রে ক্যান্সার প্রতিরোধেও সহায়তা করে।
- রক্তে কোলস্টেরলের উপস্থিতি কমাতে সাহায্য করে।
- শরীরে অতিরিক্ত আয়রনের উপস্থিতি. নিয়মিত রক্তদান এই রোগ প্রতিরোধ করে।
- স্থূলদেহী মানুষের ওজন কমাতে রক্তদান সহায়ক।
- মুমূর্ষুকে রক্ত দিলে মানসিক তৃপ্তি মেলে।
রক্তদানের শর্তগুলো
রক্তদান করলেই হবে না, রক্তদানের বিষয় কিছু কিছু ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হবে।
- রক্তদাতাকে সুস্থ থাকতে হবে এবং ১৮ থেকে ৬০ বছর বয়সী ৪৫ কেজি ওজনের যেকোনো মানুষ রক্তদান করতে পারে।
- দাতার রক্তের স্ক্রিনিং টেস্ট বা রক্ত নিরাপদ কি না তা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা।
- ভরপেটে খাওয়ার চার ঘণ্টা পর রক্ত দেওয়া শ্রেয়।
- কোনো রূপ এনার্জি ড্রিংক রক্তদানের আগে সেবন না করাই ভালো।
- যাঁদের ডায়াবেটিস ও উচ্চ রক্তচাপ পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে রয়েছে তাঁরা চিকিৎসকের পরামর্শে রক্তদান করতে পারেন।
যাঁদের রক্তদান নিষেধ
কিছু কিছু মানুষের ক্ষেত্রে রক্তদান সম্পন্নভাবে নিষেধ চলুন জেনে আসা যাক তারা কারা
- ক্যান্সার, হিমোফিলিয়া, ম্যালেরিয়াসহ জীবাণুঘটিত কোনো রোগী।
- এইচআইভি বা এইডস আক্রান্তরা।
- মাদক সেবনকারী।
- হেপাটাইটিস-বি ও সি-র এন্টিজেন পজিটিভ যাঁদের। পরবর্তী সময় তা নেগেটিভ হলেও রক্ত দেওয়া যাবে না।
- গর্ভবতী মহিলারা।
- যাঁদের অতিরিক্ত শ্বাসকষ্ট হয়।
- যাঁরা বারবার ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হন।
- গত তিন মাসের মধ্যে রক্তদান করেছেন এমন মানুষ।
- যাঁদের শরীরের কোনো স্থানের গ্ল্যান্ড লিম্ফনোড ফুলে গেছে। বিশেষ করে ঘাড়, গলায়, হাতের নিচের গ্লান্ড
রক্তদানে কি কোন ক্ষতি হয়
অনেকে রক্তদানে ভয় পান। কেউ কেউ ভাবেন এতে স্বাস্থ্যের ক্ষতি হবে, দুর্বল হয়ে পড়বেন বা রোগাক্রান্ত হয়ে পড়বেন। কেউ আবার মনে করেন এতে হৃৎপিন্ড দুর্বল বা রক্তচাপ কম হয়, এমনকি কার্যক্ষমতা কমে যাবার আশঙ্কা করেন।
তদুপরি কিছু সামাজিক বা ধর্মীয় কুসংস্কার আর অজ্ঞতা অনেক সময় মানুষকে রক্তদানে নিরুৎসাহিত করে। বলাবাহুল্য, এগুলো সম্পূর্ণ অমূলক। কেউ ধর্মের দোহাই দিয়ে বলেন- রক্তদান করা নিষিদ্ধ, তাই অন্যকে রক্তদান থেকে বিরত রাখেন। কিন্তু এগুলোর কোনো ভিত্তিই নেই।
কতদিন অন্তর রক্ত দেওয়া যেতে পারে
একবার রক্ত দেওয়ার পর অন্তত আট সপ্তাহ ৫৬ দিন বাদে ফের রক্তদান করা যায়৷ ডবল রেড সেল ডোনেশনের মধ্যে ১৬ সপ্তাহ ১১২ দিন অপেক্ষা করা উচিত৷
রক্ত দানের পর কি কি খেতে হয়
রক্তদানের পর দুই গ্লাস পানি বা জুস খেলে রক্তের জলীয় অংশটুকু পূরণ হয়ে যায়। এরপর পর্যাপ্ত পানি ও জুস পান করতে হবে, সেই সঙ্গে ৮ঘণ্টা ঘুম। খাবারে কলিজা, বিভিন্ন ধরনের কচু, ডিম, দুধ রাখতে হবে।
এক ব্যাগ রক্ত দিতে কত সময় লাগে
রক্তের অভাবের কারণে প্রতিবছর বহু রোগীর প্রাণ সংকটের মুখ পড়ে। এক ব্যাগ রক্ত দিতে সময় লাগে মাত্র ১০ থেকে ১২ মিনিট। এই অল্প সময়ে চাইলেই একজনের প্রাণ বাঁচানো সম্ভব।
রক্ত দিলে কি ওজন কমে?
রক্ত দিলে যে ক্যালোরি খরচ হয়, তা ওজন কমানোর ক্ষেত্রে ও রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
সবচেয়ে ভালো রক্তের গ্রুপ কোনটি
ও নেগেটিভ রক্তকে সার্বজনীন রক্তের ধরন বলা হয় কারণ এটি সকলের জন্য ও নেগেটিভ লোহিত কণিকা গ্রহণ করা নিরাপদ।