চিরতা খাবার উপকারিতা, অপকারিতা এবং নিয়ম
সংস্কৃতে যা ভুনিম্বা নামে পরিচিত বাংলায় তা চিরতা নামে পরিচিত যায় সোয়েরশিয়া চিরতা। চিরতা, Swertia chirata নামক গাছ থেকে পাওয়া ঔষধি গুণসমৃদ্ধ একটি ভেষজ। সারা ভারতে এটি পাওয়া গেলেও ১৮৩৯ খ্রিস্টাব্দে সর্বপ্রথম ইউরোপে এটি আবিষ্কৃত হয়।
এটি স্যালিসাইলিক সমৃদ্ধ যা অত্যন্ত তিক্ত স্বাদের জন্য পরিচিত ত্বকের সমস্যা, জ্বর এবং প্রদাহের চিকিৎসায় ঔষধি হিসেবে ব্যবহৃত হয়। প্রশস্ত পাতার এই গাছের ফল সাদা রঙের হয় এবং প্রায় ২-৩ ফুট উচ্চতাযুক্ত হয়।
আমাদের চারপাশে এমন অনেক ভেষজ রয়েছে, যা রোগের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে উপকারী। চিরতা তাদের একজন। তিক্ত স্বাদের কারণে অনেকেই চিরতা ব্যবহার করেন না।
তবে এটি যত বেশি তেতো, রোগের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে তত বেশি উপকারী। আজকের এই নিবন্ধটির মাধ্যমে, আমরা বলব যে চিরতার বৈশিষ্ট্যগুলি শারীরিক সমস্যা প্রতিরোধে কতটা উপকারী।
চিরতার পুষ্টিগুণ (প্রতি ১০০ গ্রাম)
পুষ্টি উপাদান | পরিমাণ (প্রতি ১০০ গ্রাম) | দৈনিক চাহিদার শতকরা হার* |
---|---|---|
ক্যালরি | ২৯৭ কিলোক্যালরি | ১৫% |
জলীয় অংশ | ৮-১২ গ্রাম | – |
শর্করা | ৬২ গ্রাম | ২১% |
আমিষ | ৪.৭ গ্রাম | ১০% |
চর্বি | ১.৩ গ্রাম | ২% |
ফাইবার | ৮ গ্রাম | ৩২% |
ক্যালসিয়াম | ৩৮০ মিলিগ্রাম | ৩৮% |
আয়রন | ১৩ মিলিগ্রাম | ৭২% |
ম্যাগনেসিয়াম | ৮০ মিলিগ্রাম | ২০% |
পটাশিয়াম | ৪৮০ মিলিগ্রাম | ১০% |
দৈনিক চাহিদার শতকরা হার ২,০০০ ক্যালরি খাদ্য তালিকা অনুসারে পরিমাপ করা হয়েছে।
চিরতা খাওয়ার উপকারিতা
খেতে একটু তিতা হলেও এর উপকারিতার কিন্তু কোন অভাব নেই এটি খাওয়ার ফলে অনেক বড় বড় সমস্যার সমাধান পাওয়া যায়।
চলুন জেনে আসা যাক চিরতা খাওয়ার উপকারিতা গুলো
জ্বর সারাতে
জ্বরের মতো সাধারণ রোগেও চিরতা যথেষ্ট কার্যকরী ভূমিকা পালন করে। বিশেষত ম্যালেরিয়ার সংক্রমণে এটি খুবই কার্যকর। বয়স্কদের জ্বরের ক্ষেত্রে এটি অত্যন্ত প্রভাবশালী এবং তিক্ত টনিক হিসেবে ব্যবহার করা হয়।
পেটের অসুখে
পরিপাকতন্ত্রে অ্যাসিডের উৎপাদন কমিয়ে ফেলতে সাহায্য করে চিরতা। ক্ষুদ্রান্ত্রের ফুলে যাওয়া কমাতেও সাহায্য করে এটি। এর মাধ্যমে ডায়রিয়া, গ্যাস এবং পেট ফোলার অসুখ কমানো যায়।
ওজন কমাতে সাহায্য করে
বর্তমানে ওজন কমানো এক অন্যতম সমস্যা। এর জন্যও অনেক ধরনের ওষুধও বাজারে পাওয়া যায়।
তবে চিরতার মাধ্যমে সহজেই ওজন কমানো যায়। চিরতাতে উপস্থিত মিথানল মেটাবলিজমের হার বৃদ্ধ ক’রে ওজন কমাতে সাহায্য করে। ওজন কমানোর মাধ্যমে চিরতা হার্ট ও কিডনি সুস্থ রাখে।
অনাক্রম্যতা বৃদ্ধি করে
যেকোনো রোগ সেরে ওঠা বা না ওঠা অনেকটাই নির্ভর করে আমাদের দেহের অনাক্রম্যতা বা ইমিউন সিস্টেমের উপর। চিরতা অনাক্রম্যতা বৃদ্ধি করতে সাহায্য করে।
এছাড়াও শরীর থেকে টক্সিক পদার্থ বের করে দিতেও সাহায্য করে।
রক্তশোধক হিসেবে কাজ করে
চিরতা স্বাদে তিক্ত এবং সেইসাথে করলা বা নিম যে রকম রক্ত পরিষ্কার রাখতে সাহায্য করে তেমনি এটিও রক্ত পরিষ্কার করতে সাহায্য করে। অ্যানিমিয়া থেকেও রক্ষা করতেও চিরতা খুব উপকারী।
লিভারের সমস্যায় উপকারী
লিভারের বিভিন্ন সমস্যার বিরুদ্ধে লড়াই করতে সাহায্য করে চিরতা। লিভারের কোষগুলিকে আরাম প্রদান করে ফ্যাটি লিভার,
সিরোসিস এবং লিভার সংক্রান্ত অন্যান্য অসুখ সারিয়ে তুলতে সাহায্য করে। লিভার থেকে টক্সিন মুক্ত করে এর কাজ নিয়ন্ত্রণে চিরতা যথেষ্ট জনপ্রিয় উপাদান।
কোষ্ঠকাঠিন্যে উপকারী
পেট বা পরিপাকতন্ত্র সংক্রান্ত রোগ হল কোষ্ঠকাঠিন্য। চিরতা এর চিকিৎসায় খুবই কার্যকরী। চিরতার গাছ থেকে তৈরি হওয়া শুকনো খাড়া বা গাছের কাণ্ড কোষ্ঠকাঠিন্য সহ নানা রকম পেটের সমস্যা সেরে না যাওয়া পর্যন্ত খেয়ে যেতে হবে।
ত্বকের রোগে কার্যকর
চিরতার নির্যাস ত্বকের সমস্যা থেকে মুক্তি দেয়। গিলে খেলে বা চিরতার পেস্ট বানিয়ে তা ত্বকে লাগালে ভাল উপকার পাওয়া যায়। এছাড়াও এটি ক্ষত এবং ব্রণ সারাতেও কার্যকরী।
সোরিয়াসিস সারিয়ে তুলতে
সোরিয়াসিস সারিয়ে তুলতে চিরতা সক্রিয় ভূমিকা পালন করে। এর জন্যও রাতে ৪ গ্রাম চিরতার সাথে ১২৫ গ্রাম জল মিশিয়ে পান করে পরের দিন সকালে ৩-৪ ঘন্টা খালি পেটে থাকতে হবে। ধারাবাহিকভাবে দু’সপ্তাহ এটি করলে সোরিয়াসিস থেকে মুক্তি পাওয়া যায়।
সুগার নিয়ন্ত্রণে
ব্লাডসুগার নিয়ন্ত্রণে চিরতার উপকারিতা পাওয়া যায়। ব্লাড সুগারের বিভিন্ন সমস্যা সারিয়ে তুলতে এর তিক্ত স্বাদ সাহায্য করে। প্যানক্রিয়াসের কোষে ইনসুলিনের উৎপাদন উত্তেজিত করে ব্লাডসুগার কমায় চিরতা।
আর্থরাইটিসের চিকিৎসায়
আর্থরাইটিসে জয়েন্টে ব্যথা এবং ফুলে যাওয়ার মতো সমস্যা দেখা দেয়। প্রদাহনাশম গুণের কারণে চিরতা আর্থরাইটিসের ব্যথা কমাতে সাহায্য করে। এছাড়াও যেকোনো ব্যথা, ফুলে যাওয়া, এবং লালচেভাবের চিকিৎসায় চিরতা যথেষ্ট কার্যকর।
পেটফাঁপার সমস্যায় কার্যকর
আমাদের শরীরে একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ হল ক্ষুদ্রান্ত্র। কোনরকম খাদ্য বিষক্রিয়া এবং অন্যান্য জীবাণুর কারণেও এই অঙ্গের বিভিন্ন অসুখ দেখা যায়।
ক্ষুদ্রান্ত্র থেকে কৃমি বের করে দিয়ে চিরতা এই অঙ্গকে বিভিন্ন জীবাণু এবং রোগের হাত থেকে বাঁচায়।
চিরতা খাওয়ার অপকারিতা
পৃথিবীর নিয়ম অনুসারে প্রতিটি খিলাড়ি বিপরীত প্রতিক্রিয়া রয়েছে ঠিক তেমনি চিরতা খাওয়ার উপকারিতার সাথে এর দুই একটি অপকারিতা রয়েছে।
- গর্ভবতী এবং স্তন্যদায়ী মায়েদের ক্ষেত্রে চিকিৎসকের পরামর্শের পরেই চিরতা ব্যবহার করা উচিত।
- অনেকেই এর অত্যন্ত তিক্ত স্বাদের কারণে বমি ক’রে ফেলেন বা বমিভাব দেখা দেয়। সেইসাথে ডায়াবেটিসের রোগীদের এটি ব্যবহারের ক্ষেত্রে সতর্ক থাকা উচিত।
চিরতার ব্যবহার
চিরতার উদ্ভিদ এবং মূল উভয়ই ব্যবহার করা যেতে পারে। আসুন, জেনে নেওয়া যাক চিরতা ব্যবহারের পদ্ধতি এবং পরিমাণ সম্পর্কে।
- চিরতার স্যালিসিলিক নির্যাস একটি টনিক হিসাবে দিনে দুবার খাবারের আগে গ্রহণ করা যেতে পারে। এতে শারীরিক দুর্বলতা দূর হয়।
- ১৫ থেকে ৩০ মিলি বা ১ থেকে ২ টেবিল চামচ চিরতা গরম জল এবং লবঙ্গ বা দারুচিনি দিয়ে প্রস্তুত করা যেতে পারে।
- চিরতার মূল হেঁচকি ও বমিতে উপকারী। এর ০.৫ থেকে ২ গ্রাম পরিমাণে মধুর সাথে সেবন করা যেতে পারে।
- চিরতা পাতার রস পান করতে পারেন। এটি তেতো, তাই এতে মধু যোগ করা যেতে পারে।
চিরতা খাবার নিয়ম
সোরিয়াসিস সারিয়ে তুলতে চিরতা সক্রিয় ভূমিকা পালন করে। এর জন্যও রাতে ৪ গ্রাম চিরতার সাথে ১২৫ গ্রাম জল মিশিয়ে পান করে পরের দিন সকালে ৩-৪ ঘন্টা খালি পেটে থাকতে হবে।
ধারাবাহিকভাবে দু’সপ্তাহ এটি করলে সোরিয়াসিস থেকে মুক্তি পাওয়া যায়। ব্লাডসুগার নিয়ন্ত্রণে চিরতার উপকারিতা পাওয়া যায়।
চিরতা কতদিন খাওয়া যায়
এটি একটানা ১০-১৫ দিনের বেশি খাওয়া ঠিক না। কেননা এতে হিতের বিপরীত হতে পারে যেমন কিডনির সমস্যা ও যৌন সমস্যা হতে পারে।
চিরতার দাম কত
চিরতার পাতা থেকে চিরতা গুঁড়া করা হয়। চিরতা গুঁড়া ১০০ গ্রাম ৮৫ টাকা।
চিরতা ভেজানো জল খেলে কি হয়
চিরতা ভেজানো জল কিংবা চায়ের সঙ্গে খেলে ত্বকের সমস্যা যেমন – ফুসকুড়ি, চুলকানি, জ্বালাপোড়া এবং লালচে ভাব দূর হয়।
কারণ এই ভেষজটির পুষ্টি উপাদান টক্সিন অপসারণ করতে এবং নতুন রক্ত তৈরি করতে সাহায্য করে। রক্তাল্পতার মতো রক্ত সম্পর্কিত রোগের চিকিৎসাতেও এটা দারুণ কার্যকরী।
One Comment