পাস্তা খাবার উপকারিতা, অপকারিতা এবং নিয়ম
পাস্তা একটি বিকল্প ও সুস্বাদু খাবার। অনেকটা নুডুস-এর মতই্। পাস্তা খুব সহজেই রান্না করা এবং পরিবেশন করা যায়।
পাস্তার পুষ্টি উপাদান
পাস্তার পুষ্টিগুণ এবং আমাদের দৈনিক চাহিদা পূরণের শতকরা হার সম্পর্কে এখানে একটি টেবিল তৈরি করা হলো। মনে রাখতে হবে যে পুষ্টির তথ্য পাস্তার ধরন (সাদা পাস্তা, গমের পাস্তা, ইত্যাদি) এবং মানের উপর ভিত্তি করে পরিবর্তিত হতে পারে। এই সারণিটি সাধারণ শুকনো সাদা পাস্তার জন্য তৈরি করা হয়েছে।
পাস্তার পুষ্টি উপাদান এবং দৈনিক চাহিদা পূরণের হার
পুষ্টি উপাদান | প্রতি ১০০ গ্রাম শুকনো পাস্তায় পরিমাণ | দৈনিক চাহিদার শতকরা হার* |
---|---|---|
কার্বোহাইড্রেট | ৭৫ গ্রাম | ২৫% |
প্রোটিন | ১৩ গ্রাম | ২৬% |
ডায়েটারি ফাইবার | ৩ গ্রাম | ১২% |
আয়রন | ১.৫ মিলিগ্রাম | ৮% |
ম্যাঙ্গানিজ | ১.৩ মিলিগ্রাম | ৫৭% |
দৈনিক চাহিদার শতকরা হার একজন প্রাপ্তবয়স্কের গড় প্রয়োজনের উপর ভিত্তি করে তৈরি করা হয়েছে।
পাস্তার গুরুত্ব
- শক্তির উৎস: পাস্তা প্রাথমিকভাবে কার্বোহাইড্রেটের একটি উৎস, যা শরীরকে শক্তি প্রদান করে।
- প্রোটিনসমৃদ্ধ: পাস্তায় প্রোটিন রয়েছে, যা পেশী তৈরি ও মেরামতের জন্য গুরুত্বপূর্ণ।
- ভিটামিন ও খনিজ পদার্থ: পাস্তায় বিশেষত সম্পূর্ণ গমের পাস্তায়, আয়রন এবং ম্যাঙ্গানিজের মতো খনিজ পদার্থ পাওয়া যায়।
বিবেচ্য বিষয়
- গ্লাইসেমিক সূচকে পাস্তা বেশ উপরে, তাই রক্তের শর্করার মাত্রা প্রভাবিত করতে পারে।
- পরিমিত পরিমাণে পাস্তা গ্রহণ করা উচিত। বেশি পাস্তা খেলে ওজন বৃদ্ধির কারণ হতে পারে।
- স্বাস্থ্যকর খাবারের অংশ হিসেবে প্রচুর সবজি ও লীন প্রোটিনের সঙ্গে পাস্তা খাওয়া উচিত।
পাস্তার উপকারিতা
পাস্তা ভালো হজম প্রক্রিয়া, ভিটামিন ও খনিজ পদার্থের পর্যাপ্ত উৎসের পাশাপাশি রক্তে শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করতে পারে। এটি রক্তে শর্করার প্ররিমাণ নিয়ন্ত্রণ করার কারণে, ডায়াবেটিস, হৃদরোগ ইত্যাদির ঝুঁকি কমায়।
নতুন এক গবেষণার ফলাফলে দেখা গেছে যারা পাস্তা খায় না তাদের চাইতে যারা প্রতিদিনই খায় তারা এইসব সুবিধা ভোগ করে থাকেন।
কম সোডিয়ামের কোলেস্টেরল মুক্ত পাস্তায় রয়েছে স্বল্প মাত্রায় ‘গ্লায়কেমিক ইনডেক্স’ যা রক্তে শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখে।
যুক্তরাষ্ট্রে ন্যাশনাল পাস্তা অ্যাসোসিয়েশনের ডায়েটিশিয়ান এবং ‘নিউট্রিশন কমিউনিকেশন্স ম্যানেজার’ ডায়ান ওয়েলান্ড বলেন, “গবেষণায় দেখা গেছে, পাস্তা খাদকদের বিপাকীয় অবস্থা, যারা খায় না তাদের চাইতে বেশ ভালো।”
খাবারের গ্লাইসেমিক ইনডেক্সকে পাস্তা কমায়
পাস্তাকে চীজ, বিনস বা টুনা মাছের মতন অন্যান্য খাবারের সাথে মেশানো হয় এবং এইসব উপকরণ মেশানোর জন্য পাস্তা ভিত্তিক খাবারের গ্লাইসেমিক ইনডেক্স কমে। এটা খাবারের পদকে আরও পুষ্টি উপাদানে ভরপুর করে ও পেট ভরিয়ে রাখে।
ডায়াবেটিসের জন্য উপকারী
গবেষণা প্রমান করেছে, যে বিশেষকরে গোটা শস্যর রকমফের সহ পাস্তা ডায়াবেটিসের জন্য উপকারী কারণ এর গ্লাইসেমিক ইনডেক্স কম।
টাইপ ২ ডায়াবেটিসের ঝুঁকি কমায়
কম জিআই খাদ্যে ভরতি কম-জিআই খাদ্যাভ্যাস, যেমন পাস্তা, টাইপ ২ ডায়াবেটিসের ঝুঁকি কমায়। পাস্তা ভিত্তিক কার্বোহাইড্রেট ও রাই ব্রেডও একই উপকার দেয়।
স্তন ও প্রোস্টেট ক্যান্সারের ঝুঁকি কমায়
কম গ্লাইসেমিক খাবার পাস্তা, স্তনের ক্যান্সারের ঝুঁকি যথেষ্ট পরিমাণ কমায়। অন্যদিকে টম্যাটো সস দেওয়া পাস্তা প্রোস্টেট ক্যান্সারের ঝুঁকি কমায়।
টম্যাটো প্রোডাক্ট নিয়মিত খাওয়া পুরুষদের প্রোস্টেট ক্যান্সারের ঝুঁকি কমে যায়। লাইকোপেনে, টম্যাটোর মধ্যের অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট, শরীরের ক্ষতিগ্রস্ত কোষের মেরামতি করে এবং প্রোস্টেট ক্যান্সার প্রতিরোধ করে। সুতরাং, টম্যাটো সস দিয়ে পাস্তা খান।
অ্যালজাইমারের খাবার
মেডিটেরিনিয়ান ডায়েটের অঙ্গ হিসেবে পাস্তা অ্যালজাইমার রোগ হবার ঝুঁকি কমায়। তাছাড়াও, মেডিটেরিনিয়ান ডায়েট খেলে সেটা অ্যালজাইমারে আক্রান্তদের জীবনীশক্তি বাড়িয়ে দেয়।
তলপেটের মেদ এবং ওজন বৃদ্ধি কমান
উদ্ভিজ তেল, পাস্তা এবং কম ফ্যাটযুক্ত দুধ খেলে সেটা কোমরের আশেপাশের বদলে নিতম্বের আশেপাশে ফ্যাটের সুস্থ বিতরণ করে।
পাস্তার মতন কার্বোহাইড্রেট যুক্ত খাবার, ওজন কমাতে সাহায্য করার সাথে যথাযথ ওজন বজায় রাখে। গবেষণা অনুযায়ী, ওজন কমানো মানে কার্বোহাইড্রেট কমানো নয় বরঞ্চ ক্যালোরি কমানো। সুতরাং সুস্বাদু পাস্তা যখন যথাযথ পরিমাণে খাওয়া হয়, সেটা সার্থকভাবে ওজন কমায়।
স্বাস্থ্যকর রান্না
পাস্তা কার্বোহাইড্রেট-ভারি খাবার। এটা বানানোর সময়ে, সবজি কিংবা মাংস অথবা দুটোই যথাযথ পরিমাণে যোগ করে খাবারের গ্লাইসেমিক ভার কমান।
রাইস পাস্তা, মুগ বিন পাস্তা এবং দল্যাক বিন পাস্তার মতন স্বাস্থ্যকর সংস্করণ বাছুন যার মধ্যে পুষ্টি উপাদান, ফাইবার এবং প্রোটিন পর্যাপ্ত পরিমাণে থাকে। উইট বা হোল উইট পাস্তা পুরোপুরি এড়িয়ে যান।
আপনি এখন পর্যন্ত যদি পাস্তা না পছন্দ করে থাকেন, স্বাস্থ্য সংক্রান্ত এই সব তথ্য নিশ্চিতভাবে আপনার ধারনা বদলে দিয়েছে। অতএব, এগিয়ে গিয়ে ওয়েলনেসের বাটি ছিনিয়ে নিন।
এখন ঘরেই বানান পাস্তা
৩ ধরণের রান্নার রেসিপি সহ পাস্তা বানানোর কৌশল
যা যা লাগবে
- ডিম- ২টি
- ময়দা- পরিমাণমত
- লবন- পরিমাণমত
- তেল- ২ চা চামচ
কি করে করবেন
প্রথমে একটি পাত্রে ২টি ডিম নিয়ে ভালো করে ফেটে নিন। এর সাথে পরিমাণমত লবন মেশান।
এবার ডিমের সাথে অল্প অল্প করে ময়দা মেশাতে থাকুন এবং ময়ান করতে থাকুন। রুটি বানানোর জন্য যেমন ময়ান করতে হয় তেমন ময়ান হওয়া পর্যন্ত ময়দা মেশাতে থাকুন।
ভুলেও পানি মেশাবেন না। ময়ান করা শেষের দিকে আসলে তেল মিশিয়ে নিবেন। এটি মিশ্রণ বারবার হাতে লাগা থেকে রক্ষা করবে।
ময়ান হয়ে গেলে আধাঘন্টা ময়ানটা ঢেকে রেখে দিন।
আধা ঘন্টা পর, ময়ান দিয়ে রুটি বেলুন। মনে রাখবেন, রুটি যত বেশি পাতলা হবে আপনার পাস্তা তত পার্ফেক্ট হবে।
রুটি বেলা হলে ছুরি দিয়ে পছন্দের শেইপে পাস্তা কেটে নিন। একটু চিকন আর ছোট করতে চেষ্টা করবেন।
ব্যাস পাস্তা বানানো কিন্তু হয়েই গেলো। এবার রান্নার পালা। পাস্তা অনেকভাবে রান্না করা যায়।
রান্নার সময় কড়াইয়ে পানি গরম করে তাতে কেটে রাখা পাস্তা গুলো দিয়ে দিন। ১৫/২০ মিনিট গরম পানিতে পাস্তাগুলোকে সেদ্ধ করুন। সেদ্ধ হয়ে গেলে পানি ছেঁকে বাতাসে শুকিয়ে নিন।
- সাধারণ পাস্তাঃ সাধারণ পাস্তা বলতে নুডুলসের মত রান্না করা পাস্তার কথা বলছি। একটু তেলে পেঁয়াজ, মরিচ কুচি আর লবন দিয়ে নাড়ুন। এতে আগে থেকে ঝুরি করে রাখা ডিম মেশান। নেড়ে চেড়ে সেদ্ধ করা পাস্তা মিশিয়ে ১০ মিনিটের মত চুলায় রাখুন। হয়ে গেলো সাধারণ পাস্তা।
- স্পাইসি পাস্তাঃ আপনি যদি একটু ঝালপ্রিয় হয়ে থাকেন, তবে ঝাল করে পাস্তা রান্না করতে পারেন। তেলে কিউব করে কাটা পেঁয়াজ, লবন, ৩ টেবিল চামচ টক দই আর টমেটো ক্যাচাপ দিন। এতে গোলমরিচের গুড়া আর ফালি করা মরিচ যোগ করুন। ২/৩ কাপ পানি দিয়ে তাতে পাস্তা দিয়ে রান্না করতে থাকুন। আগে থেকে সেদ্ধ করে রাখা মুরগীর বুকের মাংসের ছোট টুকরা দিন। আধা কাপ পানিতে ২ টেবিল চামচ কর্নফ্লাওয়ার গুলে এতে মিশিয়ে দিন। বারবার নেড়ে ঝোল কমা অব্দি রান্না করতে থাকুন।
- হোয়াইট চিজি পাস্তাঃ খানিকা নোনতা আর খানিকটা মিষ্টি এই পাস্তা ছোটদের একটু বেশীই প্রিয়। মাখনের সাথে দুধ আর হোয়াইট সস মিশিয়ে নিন। সেদ্ধ করা পাস্তা দিয়ে তাতে সামান্য লবন আর চিনি মিশিয়ে নিন। আগে থেকে সেদ্ধ করে রাখা মুরগীর বুকের মাংসের ছোট টুকরা দিন। এবার পনির বা চিজ ঝুরি করে তাতে মিশিয়ে নিন। মৃদু আঁচে ১৫/২০ মিনিট রান্না করুন। পাস্তা তৈরি।
পাস্তা এর ইতিহাস ও প্রচলন
পাস্তা ইতালির জনপ্রিয় খাবার হলেও এর জন্ম চীনে। তবে একথা অনেক গবেষক স্বীকার করতে চান না। কারণ চীনের আর ইতালির পাস্তার মধ্যে বেশ অনেকটাই তফাত রয়েছে। চীনে পাস্তা বলতে নুডুলসকে বোঝানো হয়েছে। সেখানে তারা বেশিরভাগ সময় ভাত দিয়ে বা চালের গুঁড়া থেকে নুডুলস বা পাস্তা তৈরি করে। আর ইতালিয়ান পাস্তা তৈরি হয় গমের আটা, ডিম আর দুধ দিয়ে।
বিশ্বের অন্যতম ভ্রমণকারী মার্কো পোলো চতুর্দশ শতাব্দীতে চীন ভ্রমণের সময় পাস্তা আবিষ্কার করেন। সেখানে ৩০০০ খ্রিষ্টপূর্ব থেকেই পাস্তা খাওয়ার চল রয়েছে। মার্কো তার লেখায় একটি গাছের কথা উল্লেখ করেছিলেন যা থেকে পাস্তা তৈরি করত চীনারা। যেটি এখন আমদের কাছে সাবু দানা হিসেবে পরিচিত।
নোক্রাটিস-এর গ্রীক কথাসাহিত্যিক অ্যাথেনিয়াস লাগনার প্রথম শতাব্দীতে পাস্তার একটি রেসিপি দিয়েছিলেন। সেখানে তিনি ময়দার সঙ্গে লেটুস পাতার গুঁড়া,বিভিন্ন মশলা এবং জলপাই তেল ব্যবহার করেছিলেন। খ্রিস্টীয় দ্বিতীয় শতাব্দীতে গ্রীক চিকিৎসক গ্যালেনের রচনায় পাওয়া যায় পাস্তা তৈরির পদ্ধতি। সেখানে তিনি ময়দা আর পানি তৈরি একধরনের পাস্তার কথা লিখেছিলেন।
খাদ্য ইতিহাসবিদরা মনে করেন ত্রয়োদশ শতাব্দীতে মধ্যযুগের বৃহত্তর ভূমধ্যসাগরীয় ব্যবসায়ের মাধ্যমে ইতালিতে পাস্তার আগমন। সেসময় থেকে ষোড়শ শতাব্দীর শুরু পর্যন্ত ধীরে ধীরে এর প্রচলন শুরু হয়। এরপর এটি ইতালিয়ানদের প্রধান খাবারে পরিণত হয়। দক্ষিণ ইতালীয়দের মতে অষ্টম শতাব্দীতে আরব অঞ্চল থেকে সেখানে অনেক মানুষ আসে। তাদের মাধ্যমেই নাকি এদেশে এসেছিল পাস্তা।
বর্তমানে আমরা যে ম্যাকারোনি খাই তা এসেছে সিসিলিয়ান থেকে। সেসময় সিসিলিয়ায় গম উৎপাদন হতো অনেক বেশি। অন্যান্য ফসল ভালো না হওয়ায় তারা ময়দাকে খাবারের মূল উপকরণ হিসেবে বেছে নেয়।
ময়দার সঙ্গে ডিম আর পানি মশিয়ে ডো তৈরি করে প্রথমে। তারপর লম্বা করে কেটে সিদ্ধ করে টমেটো সস, মাংস দিয়ে রান্না করে খেত। যদিও সেসময় সিসিলিয়ানরা পাস্তায় বাদাম, কিসমিস, দারুচিনি ব্যবহার করত।
বিংশ শতাব্দীতে এসে আমেরিকানরা পাস্তার সঙ্গে পরিচিত হয়। এরপর থেকে যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন রেস্তোরাঁয় বেশ চড়া দামে বিক্রি হতে থাকে পাস্তার নানা পদ। ১৯৩৫ সালে পাস্তার প্রথম বিজ্ঞাপন বের হয়।
ইতালিয়ানরা এখনো টাটকা পাস্তা খেতে পছন্দ করে।
তবে ব্যস্ত জীবনকে সহজ করতে এবং বাণিজ্য করতে পাস্তা প্রক্রিয়াজাত করে প্যাকেটজাত করা হয়। সেসময় পাস্তা তৈরি করে কাঠের লম্বা লম্বা তারে শুকানো হত। এরপর প্যাকেটে ভরে বিক্রি জন্য প্রস্তুত করা হত।
অনুমান করা হয় ইতালিয়ানরা বছরে গড়ে ষাট পাউন্ড পাস্তা খেয়ে থাকে। তারা পাস্তা রান্না করতে বিভিন্ন সসের সঙ্গে ভেড়া এবং শূকরের মাংস ব্যবহার করে। মাঝে মাঝে সবজিও ব্যবহার করে থাকে পাস্তায়।
ইতালির পরেই আমেরিকায় পাস্তার জনপ্রিয়তা সবথেকে বেশি। তারা নিজেদের চাহিদা মিটিয়ে সারাবিশ্বে পাস্তার চাহিদা মেটাচ্ছে। এতে অর্থনৈতিকভাবেও বেশ অর্জন হচ্ছে তাদের এই খাতে।