মাশরুমের উপকারিতা, অপকারিতা এবং খাওয়ার নিয়ম
মাশরুম সাধারণভাবে ব্যাঙের ছাতা নামে পরিচিত ছত্রাকের মাংসল কোমল ও ভঙ্গুর বীজাধার। মাশরুমের প্রকৃত দেহ নামের আণুবীক্ষণিক সূক্ষ্ম সুতার মতো একটি কাঠামো, যা কোন ভিতবস্ত্তর উপর বা মাটির নিচে জন্মায়।
পূর্ণবয়স্ক অবস্থায় অনেকগুলি একত্রে একটি নিরেট কাঠামো গড়ে তোলে এবং মাটির উপরিভাগে উঠে ছাতার আকৃতি ধারণ করে।
মাশরুম চাষ প্রাচীন গ্রিক, রোম ও ভারতীয় সাহিত্যে ব্যাঙের ছাতা রাজন্যবর্গের একটি লোভনীয় খাদ্য হিসেবে বর্ণিত হয়েছে। বিশ শতকের শুরুতে ইউরোপেই প্রথম মাশরুমের বাণিজ্যিক চাষ শুরু, আর বাংলাদেশে হয়েছে অতি সম্প্রতি।
বিগত শতকে আশির দশকের গোড়ার দিকে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিলের উদ্যোগে মাশরুমের চাষ শুরু হয়, এরপর সাভারে ‘মাশরুম চাষ কেন্দ্র’ প্রতিষ্ঠিত হয়।
মাশরুমের পুষ্টি উপাদান
মাশরুম আমাদের বিভিন্ন পুষ্টির চাহিদা পূরণে ভূমিকা রাখে, কিন্তু একটি তালিকা করা যেখানে সঠিকভাবে এর শতকরা পরিমাণ হিসাব করা যায় তা বেশ জটিল। কারণ:
- মাশরুমের বিভিন্ন প্রজাতি: মাশরুমের বিভিন্ন প্রজাতি (যেমন বাটন মাশরুম, ঝিনুক মাশরুম, ইত্যাদি) তাদের পুষ্টি উপাদানের উপস্থিতিতে ভিন্ন হয়।
- প্রস্তুতপ্রণালী জরুরী: মাশরুম কীভাবে প্রস্তুত করা হয়েছে তার উপর পুষ্টি উপাদানের মাত্রা বিভিন্ন হতে পারে।।
- পরিবর্তনশীল দৈনিক চাহিদা: একজন ব্যক্তির দৈনিক পুষ্টির প্রয়োজনীয়তা তাদের বয়স, লিঙ্গ, এবং কার্যকলাপের স্তর ইত্যাদির উপর নির্ভর করে।
আনুমানিক পুষ্টি উপাদানের তালিকা (প্রতি ১ কাপ রান্না করা সাদা মাশরুম)
পুষ্টি উপাদান | পরিমাণ (আনুমানিক) | দৈনিক চাহিদা পূরণের শতাংশ (আনুমানিক)* |
---|---|---|
ক্যালোরি | ২১ | ১.০৫% |
মোট কার্বোহাইড্রেট | ৩ গ্রাম | ১% |
ফাইবার | ২ গ্রাম | ৮% |
প্রোটিন | ৩ গ্রাম | ৬% |
নিয়াসিন (ভিটামিন B3) | ৩ মিলিগ্রাম | ১৮.৭৫% |
রিবোফ্লাভিন (ভিটামিন B2) | ০.৪ মিলিগ্রাম | ৩০.৭৭% |
পটাশিয়াম | ৩০০ মিলিগ্রাম | ৬.৩৮% |
সেলেনিয়াম | ১৫ মাইক্রোগ্রাম | ২৭.২৭% |
*একটি ২০০০ ক্যালোরির ডায়েট এবং গড় প্রাপ্তবয়স্কদের চাহিদার উপর ভিত্তি করে।
গুরুত্বপূর্ণ বিষয়সমূহ:
- ফাইবার ও ভিটামিনের ভালো উৎস : মাশরুম ফাইবার এবং বিভিন্ন B-ভিটামিন এর একটি ভালো উৎস।
- সেলেনিয়ামের উপস্থিতি: মাশরুমে সেলেনিয়াম আছে, একটি শক্তিশালী অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট এবং খনিজ।
- অন্যান্য খনিজের অল্প পরিমাণ: মাশরুমে অল্প পরিমাণে পটাশিয়াম, তামা ইত্যাদি উপস্থিত থাকে।
- কম ক্যালোরিযুক্ত: মাশরুমে খুব কম ক্যালোরি আছে, তাই এটি ওজন নিয়ন্ত্রণের সহায়ক হতে পারে।
মাশরুমের উপকারিতা
মাশরুমে পেনিসিলিন নামক অ্যান্টিবায়োটিক থাকে যা মানুষের জন্য বেশ উপকারী এবং এটি খেতে খুবই মজা।
তাই প্রতিদিনের খাদ্যতালিকায় মাশরুম রাখা উচিত। তবে শুধু অর্গানিক বা জৈব ভাবে উৎপন্ন মাশরুম খেতে হবে। বুনো জায়গায় উৎপন্ন মাশরুম অবশ্যই গ্রহণ করা নিষেধ।
এতে আছে প্রোটিন, ভিটামিন, মিনারেল, অ্যামাইনো এসিড, অ্যান্টিবায়োটিক ও অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট। চলনু জেনে নেয়া যাক মাশরুমের সাস্থ্যকর দিকগুলো-
- দাঁত ও হাড়ের গঠনে মাশরুম: মাশরুমে প্রচুর পরিমাণে ক্যালসিয়াম, ফসফরাস ও ভিটামিন -ডি রয়েছে। যা বাচ্চাদের দাঁত ও হাড় গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
- কোলেস্টেরল কমাতে: মাশরুমে রয়েছে ইরিটাডেনিন,লোভস্ট্রাটিন, অ্যান্টাডেনিন। যা কোলেস্টেরল কমাতে গুরুদায়িত্ব পালন করে। নিয়মিত মাশরুম খাওয়া স্বাস্থ্যের জন্য ভীষণ উপকারী।
- ইমিউনিটি সিস্টেম বাড়ায়: শরীরে এন্টিবডি তৈরি হওয়া খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তা না হলে শরীরে বাসা বাঁধে নানা রকম অসুখ।মাশরুম পলিফেনল ও সেলেনিয়াম এর উৎস যাতে থাকে অনেক এন্টিঅক্সিডেন্ট।যেগুলোর ভেষজ গুন জীবন ঘাতী কিছু রোগ যেমন- স্ট্রোক, স্নায়ুরোগ ও ক্যান্সার এর থেকে শরীরকে সুরক্ষা দেয়।এতে থাকা সালফার ও ইমিউনিটি বুস্ট করে রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়িয়ে তোলে।
- টিউমারের আশঙ্কা কমায়:বর্তমান সময়ে মেয়েদের প্রায়ই স্তন টিউমার বা জরায়ুর টিউমার ধরা পড়ছে। গাইনকোলজিস্ট রাও এটি নিয়ে চিন্তিত। অপারেশন এর ঝক্কি এড়াতে তাই খাওয়া শুরু করুন মাশরুম।
- কারণ এর বেটা ডি, ল্যাম্পেট্রোল, টারপিনওয়েড ও বেনজোপাইরিন উপাদান ক্যান্সার ও টিউমার এর সম্ভাবনা প্রতিহত করে দেয়।
- প্রসূতি ও সন্তানদের প্রতিপালনে: মাশরুমে থাকা ভিটামিন ও মিনারেল এর জটিল বন্ধন আমাদের শারীরবৃত্তীয় কাজকে বিশেষরূপে সচল রাখে।যে সকল মায়েরা প্রসূতি তারা নিশ্চিন্তে এটি খেতে পারেন কারণ এতে আছে নিয়াসিন এস্কর্বিক এসিড যা গর্ভস্থ শিশুর শরীরে লোহিতকনিকার যোগান বাড়িয়ে দেয়। প্রসব হয়ে ওঠে সহজ। তাই নিয়মিত মাশরুম খাওয়া স্বাস্থ্যের জন্য ভীষণ উপকারী।
- রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি: প্রাকৃতিকভাবে মাশরুমে সবচেয়ে বেশি ভিটামিন ও মিনারেল এবং অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট বিদ্যমান থাকায় এটি মানবদেহের রোগ প্রতিরোধক ক্ষমতা বৃদ্ধি করে। মাশরুমে মানুষের শরীরের জন্য অত্যাবশ্যকীয় অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট পলিফেনল ও সেলেনিয়াম নামের অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট যা মারাত্মক কিছু রোগ, যেমন- স্ট্রোক, স্নায়ুতন্ত্রের রোগ এবং ক্যান্সার থেকে শরীরকে রক্ষা করে।
- হজমে সাহায্য ও ওজন নিয়ন্ত্রণ: মাশরুমে থাকা প্রচুর ফাইবার বা আঁশ দীর্ঘক্ষণ পেট ভরা রাখতে সহায়তা করে। এছাড়া এটি রক্তের চিনির পরিমাণও নিয়ন্ত্রণ করতে ভুমিকা রাখে। ফলে দেহের ওজন কমাতে বিশেষ ভুমিকা রাখতে পারে এই মাশরুম।এতে থাকা ফাইবার ও এনজাইম হজমেও সহায়তা করে। এটি অন্ত্রে উপকারি ব্যাকটেরিয়ার কাজ বৃদ্ধি এবং কোলন এর পুষ্টি উপাদান শোষণকেও বাড়তে সাহায্য করে। তাই অধিক ফ্যাট সমৃদ্ধ লাল মাংসের না খেয়ে মাশরুম খেয়ে ওজন কমানোর সুযোগ গ্রহণ করা যেতে পারে।
- অ্যানিমিয়া বা রক্তশূন্যতা দূর: রক্তে আয়রনের পরিমাণ খুব কমে গেলে রক্তশূন্যতা দেখা দেয় এবং যার ফলে মানসিক অবসাদ, মাথার যন্ত্রণা এবং হজমের সমস্যা দেখা দেয়। মাশরুমে প্রচুর পরিমাণে আয়রন থাকায় অ্যানিমিয়ার রোগীদের জন্য এটি আশীর্বাদ স্বরূপ। তাই নিয়মিত মাশরুম খাদ্য তালিকায় রাখলে অ্যানিমিয়া বা রক্তশূন্যতা হওয়ার ঝুঁকি অনেক কমে যায়।
- ক্যান্সার প্রতিরোধ করে: মাশরুমের ফাইটোকেমিক্যাল টিউমারের বৃদ্ধিতে বাঁধার সৃষ্টি করে। বিভিন্ন রকম ক্যানসার যেমন স্তন এবং প্রস্টেট ক্যানসার প্রতিরোধে মাশরুমের তুলনা নেই।
- 10. ত্বক সুস্থ রাখা: মাশরুমে ভিটামিনের মধ্যে প্রচুর পরিমাণে নিয়াসিন ও রিবোফ্লাবিন থাকায় তা ত্বকের জন্য বেশ উপকারী। তাছাড়া এর মধ্যে প্রায় ৮০-৯০ ভাগ পানি থাকে বলে ত্বককে নরম ও কোমল রাখতে বিশেষ ভুমিকা রাখে।
মাশরুম এর অপকারিতা
মাসুম খাওয়ার অনেক উপকারিতা থাকলেও এর অপকারিতাও রয়েছে অপকারিতা গুলো জেনে আসা যাক
- অপরিচিত বুনো মাশরুম খাওয়া ঠিক নয় কারণ এর কিছু প্রজাতি বেশ বিষাক্ত। বিষাক্ত মাশরুম খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করলে মানুষ ও প্রাণীর মৃত্যু হতে পারে।
- মাশরুম কাঠের গুড়ি, খড়, বাঁশ প্রভৃতির উপর জন্মে তাদের ক্ষতি সাধন করে।
বিষাক্ত মাশরুম চেনার উপায়
- বেশির ভাগ উজ্জ্বল বর্ণের প্রজাতি গুলো বিষাক্ত হয়ে থাকে।
- অম্লগন্ধযুক্ত ও ঝাঁঝালো প্রজাতি গুলো বিষাক্ত।
- বিষাক্ত প্রজাতি গুলোর ব্যাসিডিওস্পোর বেগুনি রঙের।
- বিষাক্ত মাশরুম কখনো প্রখর রোদে জন্মায় না।
- কাঠের উপর জন্মায় এমন প্রজাতিগুলো বিষাক্ত।
মাশরুম খাওয়ার পদ্ধতি
মাশরুম যে কেবল খেতেই সুস্বাদু তাই নয়, এটি আমাদের স্বাস্থ্যের জন্যও অনেক উপকারী। তাই প্রতিদিনের খাদ্যতালিকায় মাশরুম রাখা উচিত। তবে আবর্জনায় উৎপন্ন মাশরুম না খেয়ে শুধু চাষ করা মাশরুম খেতে হবে। এটি ভেজে, সুপ করে বা রান্না করে কিংবা সালাদ হিসেবেও খাওয়া যায়।
কাঁচা বা শুকনা মাশরুম ১৫ থেকে ২০ মিনিট ফুটানো গরম পানিতে ভিজিয়ে রেখে ভালোভাবে ধুয়ে নিয়ে উক্ত পানি ফেলে দিতে হয়। মাশরুম ফ্রাই করে বা সবজির মতো রান্না করেও খাওয়া যায়। এছাড়া তরকারি বা মাছ-মাংশের মধ্যে দিয়ে রান্না করে খাওয়া যায়।
মাশরুমের আচার
উপকরণ
- মাশরুম : ২৫০ গ্রাম
- রসুন : ১০ গ্রাম
- আদা : ২০ গ্রাম
- সরিষার গুড়া : ২০ গ্রাম
- শুকনা মরিচ : ৫ গ্রাম
- মরিচের গুড়া :২ গ্রাম
- পিঁয়াজ : ১০০ গ্রাম
- ভিনেগার : আধা কাপ
- কাঁচা মরিচ : ৫-৭ টা
- লবণ: পরিমাণমত
- সরিষার তেল : ১০০ গ্রাম
- চিনি : ১০০ গ্রাম
প্রস্তুত প্রণালী
মাশরুম টুকরো করে ৫-১০ মিনিট কুসুম গরম পানিতে ব্লানচিং করে নিন। কড়াইতে তেল গরম করে নিয়ে আদা রসুন ও পিঁয়াজ বাটা মিশিয়ে নাড়ুন। তাতে মাশরুম গুলো দিয়ে ভালভাবে মিশিয়ে নিন।
তারপরে ভিনেগার, চিনি, শুকনা মশলা মরিচ, লবণ ও সরিষার গুড়া দিয়ে ভালোভাবে ফুটিয়ে নিন। চুলা থেকে নামিয়ে ঠাণ্ডা করে জীবাণুমুক্ত করে সংরক্ষণ করুন।
মাশরুমের কোপ্তা
উপকরণ
- মাশরুম : ২৫০ গ্রাম
- বেসন : ৩ টেবিল চামচ
- হলুদ গুঁড়ো : আধা চা চামচ
- মরিচ গুঁড়ো : ১ চা চামচ
- লবণ : ১ চা চামচ
- সয়াবিন তেল : আধা কাপ
প্রস্তুত প্রণালি
মাশরুম পরিষ্কার করে ধুয়ে বেটে নিন। সব উপকরণ একসঙ্গে মিশিয়ে নিন। প্রয়োজনে সামান্য পানি দিন। ছোট ছোট বল বানিয়ে ডুবো তেলে ভেজে তুলুন। গরম গরম পরিবেশন করুন।
মাশরুম সংরক্ষণ নিয়ম
মাশরুম রোদে, ডিহাইড্রেশন পদ্ধতিতে অথবা ইলেকট্রিক ড্রায়ারে শুকিয়ে এয়ার টাইট প্যাকেটে অথবা প্লাস্টিক বোতলে ৫-৬ মাস রেখে সংরক্ষণ করা যায়। শুকনা মাশরুম ব্লেন্ডার মেশিনে পাউডার করে এয়ার টাইট প্যাকেটে রেখে একই ভাবে ৫-৬ মাস সংরক্ষণ করা যায়।
সম্পূরক খাদ্য হলেও অন্যান্য খাবারের সাথে রান্না করলে এর স্বাদ বহুগুণে বেড়ে যায়। অনেক আগে থেকে ব্যবহার করে আসা মাশরুমের গুনাবলী বলে শেষ করার মতো নয়। তাই আসুন বেশী বেশী করে মাশরুম খাই এবং আমাদের শরীরকে করে তুলি রোগ প্রতিরোধ্য।