কোয়েল পাখির ডিমের উপকারিতা, অপকারিতা এবং খাবার নিয়ম
পৃথিবীতে যত ধরণের ডিম খাদ্য উপোযোগী রয়েছে তার মধ্যে গুণে মানে পুষ্টিতে ভরপুর হলো কোয়েল পাখির ডিম। সাধারণত বয়স ৪০ পার হলেই ডিম পরিহার করতে বলা হয় । কেননা ব্রয়লারের ডিমগুলো খেলে কোলেস্টেরল এর মাত্রা বেড়ে যায় কিন্তু তার পরিবর্তে কোয়েল পাখির ডিম যেকোনো বয়সের মানুষেরা সহজেই নিসঃকোচে খেতে পারবেন।
আমাদের দেশে ইদানিং খাবার হিসেবে কোয়েল পাখির ডিমের বেশ জনপ্রিয়তা লক্ষ করা যাচ্ছে। গড়ে উঠছে অনেক কোয়েল পাখির খামার। তাই এ ডিমের পুষ্টিগুণ ও স্বাস্থ্য উপকারের কথা জানতে চান অনেকে।
কোয়েলের ডিমে পুষ্টি
আসুন জেনে নিই একটি কোয়েলের ডিমে কতটা পুষ্টি উপাদান থাকে।
- ক্যালরিঃ ১৪
- ফ্যাটঃ ১ গ্রাম
- ওমেগা-৩ ফ্যাটি এসিডঃ ৪ মিলিগ্রাম
- ওমেগা-৬ ফ্যাটি এসিডঃ ৮৪ মিলিগ্রাম
- প্রোটিনঃ ১.২ গ্রাম
- কোলেস্টেরলঃ ৭৬ মিলিগ্রাম
- ভিটামিন ও মিনারেল
- ভিটামিন এঃ ১%
- রিবোফ্লাভিনঃ ৪%
- ভিটামিন বি১২ঃ ২%
- প্যানথোনিক এসিডঃ ২%
- আয়রনঃ ২%
- সেলেনিয়ামঃ ৪%
- ফসসরাসঃ ২%
কোয়েল পাখির ডিমে বিভিন্ন পুষ্টি উপাদান থাকলেও, সুনির্দিষ্ট টেবিল তৈরি করা যেখানে এটি আমাদের দৈনিক চাহিদা পূরণ করে সেটা কয়েকটি কারণে জটিল:
- ডিমের আকার: কোয়েল পাখির ডিম মুরগির ডিমের তুলনায় অনেক ছোট, তাই একই সংখ্যার ডিমের পুষ্টির মাত্রা ভিন্ন।
- পরিবর্তনশীল দৈনিক চাহিদা: একজন ব্যক্তির দৈনিক পুষ্টির প্রয়োজনীয়তা তাদের বয়স, লিঙ্গ, এবং কার্যকলাপের স্তরের উপর নির্ভর করে।
- সীমিত উপাত্ত: মুরগির ডিমের তুলনায় কোয়েল পাখির ডিমের পুষ্টির উপাদানের তথ্য কম পাওয়া যায়।
আনুমানিক পুষ্টি উপাদানের তালিকা (প্রতি ৫টি কোয়েল পাখির ডিম)
পুষ্টি উপাদান | পরিমাণ (আনুমানিক) | দৈনিক চাহিদা পূরণের শতাংশ (আনুমানিক)* |
---|---|---|
ক্যালোরি | ৭১ | ৩.৫৫% |
প্রোটিন | ৬ গ্রাম | ১২% |
মোট চর্বি | ৫ গ্রাম | ৭.৬৯% |
আয়রন | ১.৬৫ মিলিগ্রাম | ৯.১৭% |
ভিটামিন B12 | ০.৬৪ মাইক্রোগ্রাম | ২৬.৬৭% |
ভিটামিন A | ১২৫ IU | ২.৫% |
*একটি ২০০০ ক্যালোরির ডায়েট এবং গড় প্রাপ্তবয়স্কদের চাহিদার উপর ভিত্তি করে।
কোয়েল পাখির ডিমের উপকারিতা
কোয়েল পাখির ডিম আকারে ছোট হলেও এর উপকারিতার কোন অভাব নেই। কোয়েল পাখির ডিমের স্বাস্থ্য গুনাগুণ:
শক্তি বর্ধক
কোয়েলের ডিম আমাদের শরীরের জন্য বেশ ভালো একটি শক্তির উৎস হতে পারে। কোয়েলের ডিম প্রোটিন ও আয়রনে সমৃদ্ধ, যা শরীরের এনার্জি লেভেল বাড়িয়ে দিতে বিশেষ ভূমিকা রাখে।
সব ধরণের প্রোটিনই বহু অ্যামিনো এসিড অণুর দ্বারা তৈরি চেইন দিয়ে গঠিত হয়। কোয়েলের ডিমের অ্যামিনো এসিড প্রোফাইল তৈরি করে দেখা যায়, এতে বেশ গুরুত্বপূর্ণ কিছু অ্যামিনো এসিড বিদ্যমান।
শরীরের ব্লাড শুগার নিয়ন্ত্রণে এদের মধ্যে কয়েকটি অ্যামিনো এসিড বেশ কার্যকর ভূমিকা পালন করে। অন্য কয়েকটি অ্যামিনো এসিড রয়েছে যারা টিস্যুর ক্ষয়রোধ ও নতুন টিস্যু গঠন করে। এছাড়াও কোয়েল পাখির ডিমে পাওয়া যায় লাইসিন নামক অ্যামিনো এসিড,
যা শরীরে অ্যান্টিবডি তৈরিতে এবং হরমোন, কোলাজেন ও এনজাইম উৎপাদনে ভূমিকা রাখে। নতুন রক্ত তৈরিতে আয়রনের ভূমিকা বেশ তাৎপর্যবহ। শরীরে আয়রনের অভাব হলে অ্যানেমিয়া বা রক্ত স্বল্পতা দেখা দেয়, যার ফলে ঘন ঘন ক্লান্তি ও শ্বাস-প্রশ্বাসে অসুবিধা দেখা যায়।
ক্যান্সার প্রতিরোধে
কোয়েলের ডিমে প্রাপ্ত খণিজ উপাদানগুলোর একটি হলো সেলেনিয়াম। এই খণিজ দ্রব্যটি প্রোস্টেট ক্যান্সারের ঝুঁকি কমাতে সাহায্য করে। সেলেনিয়ামে রয়েছে এন্টি অক্সিডেন্ট যা আমাদের দেহকোষকে ক্ষয় হয়ে যাওয়া ও জারণ থেকে রক্ষা করে।
এইচ আই ভি ও ক্রন’স ডিজিজ আক্রান্ত মানুষের দেহে সেলেনিয়ামের অভাব লক্ষ্য করা যায়। স্বাভাবিক মানুষের শরীরে সেলেনিয়ামের তেমন ঘাটতি পরিলক্ষিত না হলেও প্রতিদিনের খাদ্যাভ্যাসে সেলেনিয়ামযুক্ত খাদ্য রাখাটা স্বাস্থ্যের পক্ষে ভালো। সেক্ষেত্রে কোয়েলের ডিম অনেক সহায়তা করতে পারে।
যকৃত, ত্বক, চুল ও চোখের সুরক্ষায়
রিবোফ্লাভিন, যা মূলত ভিটামিন বি ২ নামে পরিচিত, দেহের বিভিন্ন শারীরবৃত্তিক প্রক্রিয়ার জন্য খুবই দরকারী। সাধারণত ভিটামিন বি ২ সহ অন্যান্য বি শ্রেণীর ভিটামিন আমাদের লিভার, ত্বক, চুল ও চোখের সুস্থতা নিশ্চিত করে।
শরীরে লোহিত রক্ত কণিলা উৎপাদনেও রিবোফ্লাভিন খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। কোয়েলের ডিমে আকারের অনুপাতে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে রিবোফ্লাভিন, একের অধিক কোয়েলের ডিম নিয়মিত খেলে তা আমাদের লিভার, ত্বক, চুল, চোখের সুস্থতার জন্য যথেষ্ট!
মস্তিষ্ক এবং স্নায়ুতন্ত্রের সুস্থতা নিশ্চিতে
আমাদের মস্তিষ্কের কার্যকলাপ ও সামগ্রিক স্বাস্থ্যের জন্য ভিটামিন বি১২, থাইমিন ভিটামিন বি১ ও ভিটামিন বি২ বেশ গুরুত্বপূর্ণ। প্রয়োজনীয় পরিমাণে ভিটামিন বি১২ আমাদের স্মৃতিশক্তির ক্ষয় রোধ করতে সহায়ক। কোয়েলের ডিম ভিটামিন বি১২ এবং রিবোফ্লাভিন ভিটামিন বি১২ এর একটি ভালো উৎস। কিছু পরিমাণ থাইমিনও ভিটামিন বি১ এতে বিদ্যমান।
অ্যালার্জিজনিত রোগ প্রতিরোধ করে
পরিবেশ দূষণের মাত্রা বেড়ে যাওয়ায় অনেকেই অ্যালার্জিজনিত রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন। কোয়েলের ডিম এসব সর্দি ও কাশির বিরুদ্ধে কাজ করতে পারে।
এতে রয়েছে অ্যালার্জি প্রতিরোধকারী উপাদান। গবেষণায় দেখা যায় কোয়েলের কাঁচা ডিম অ্যালার্জির লক্ষ্মণ ও মাত্রা উভয়ই কমিয়ে দিতে পারে।
হাঁপানি শিথিল করে
কোয়েলের ডিমের অ্যালার্জি প্রতিরোধকারী উপাদান হাঁপানির বিরুদ্ধেও কাজ করে। ধুলোবালির জীবাণুতে আক্রান্ত ১৮০ জন হাঁপানি আক্রান্ত শিশু নিয়ে করা একটি গবেষণায় দেখা যায়, যারা কোয়েল পাখির ডিম খেয়েছে তাদের হাঁপানির তীব্রতা ও অস্থিরতা উল্লেখযোগ্যহারে কম।
ত্বক কোমল রাখে
কোয়েলের ডিমের সাদা অংশে লাইসিন-৮ নামে এক ধরনের অ্যামিনো অ্যাসিড থাকে। ত্বকে কোলাজেন গঠনে লাইসিন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। কোলাজেন হলো একটি প্রোটিনের নাম যা ত্বক কোমল রাখে ও ত্বকের প্রতিরোধী ক্ষমতা বাড়ায়। আমাদের শরীর এ ধরনের অ্যামিনো অ্যাসিড তৈরি করে না। তাই এর ঘাটতি পূরণে কোয়েল পাখির ডিম খাওয়া প্রয়োজন।
রাতকানা রোগ প্রতিরোধ করে ও চোখ ভালো রাখে
এই ডিম ভিটামিন ‘এ’ এর ভালো উৎস। যা চোখের স্বাস্থ্য ভালো রাখে। ভিটামিন ‘এ’ অল্প আলোয় চোখকে দেখতে সাহায্য করে ও অন্ধত্ব প্রতিরোধ করে। এছাড়াও ভিটামিন ‘এ’ চোখের কর্নিয়া ও অন্য অংশে পুষ্টি দেয়। এর অভাবে বাচ্চাদের রাতকানা রোগ হয়।
ডায়াবেটিস মোকাবিলা করে
ডায়াবেটিস একটি বিপদজনক অবস্থা যা কেবল বাড়তেই থাকে। ঐতিহ্যবাহী চীনা ওষুধে খাবার তালিকায় কোয়েলের ডিমের মাধ্যমে ডায়াবেটিসের চিকিৎসা করা হয়।
কোয়েল পাখির ডিমের ক্ষতিকর দিক
কোয়েল পাখির ডিমের যেমন উপকারিত রয়েছে ঠিক তেমনি ভাবে এর ক্ষতিকর কিছু দিক রয়েছে। চলুন কোয়েল পাখির ডিমের ক্ষতিকর কিছু দিক দেখে নেই।
ডায়াবেটিস ও হৃদরোগীদের সমস্যার কারণ
যারা ডায়াবেটিস ও হৃদরোগ আছে তাদের যদি নিয়ন্ত্রণের বাইরে থাকে হয়,তাহলে তাদের ক্ষেত্রে কোয়েলের ডিম এডিয়ে চলা উচিত। কারণ এতে প্রচুর পরিমাণে ফ্যাট আছে। এই ফ্যাট ডায়াবেটিকস ও হৃদরোগীদের সমস্যার কারণ হতে পারে।
কোলেস্টেরল এর সমস্যা বাড়ায়
কোয়েল পাখির ১০০গ্রাম ডিমে থাকে ৮৪৪ গ্রাম কোলেস্টেরল। যা অন্যান্য ডিম থেকে বেশি। তাই যাদের কোলেস্টেরল এর সমস্যা বেশি তাদের উচিত এই ডিম অতিরিক্ত খাওয়া পরিহার করা।
কোয়েল পাখির ডিম খাওয়ার নিয়ম
কোয়েলের ডিম প্রাণীজ খাদ্যদ্রব্য হলেও এর মধ্যে প্রোটিন, ভিটামিন, মিনারেল, এনজাইম এবং অ্যামাইনো এসিড এমন মাত্রায় থাকে যে এই ডিম খেলে শরীরে সব ধরণের পুষ্টির অভাব পূরন হয় এবং শরীরের কার্যক্ষমতা বেড়ে যায়।
কোয়েল পাখির ডিম খেলে কি হয়
কোয়েলের ডিমে ভিটামিন বি-১ এর পরিমান মুরগীর ডিম থেকে ছয়গুণ বেশী, আয়রন ও ফসফরাস পাঁচ গুণ বেশী, ভিটামিন বি-২ পনেরো গুণ বেশী। বাচ্চাদের মানসিক, শারীরিক এবং বুদ্ধিমত্তার বিকাশ ঘটাতে সহায়তা করে থাকে কোয়েলের ডিম। চীনারা কোয়েলের ডিমকে টিবি, অ্যাজমা, এবং ডায়াবেটিস রোগের ওষুধ হিসেবে ব্যবহার করে থাকেন।
মুরগির ডিম ও কোয়েলের ডিমের পার্থক্য
কোয়েলের ডিম মুরগির ডিমের চেয়ে ছোট কিন্তু ওজনে বেশি চর্বি, প্রোটিন, আয়রন, রিবোফ্লাভিন এবং ভিটামিন বি১২ থাকে। যাইহোক, এগুলি আরও ব্যয়বহুল এবং মুরগির ডিমের চেয়ে খুঁজে পাওয়া কঠিন।
#একটি মুরগির ডিম সমান কতটি কোয়েল পাখির ডিম
প্রায় তিনটি কোয়েলের ডিম একটি মুরগির ডিমের সমান। তবে আপনাকে বোকা বানাতে দেবেন না যে তারা একটি ভাল পছন্দ নয়। আপনি এগুলিকে এক কামড়ে খেতে পারেন যাতে সমস্ত জায়গায় কুসুম প্রবাহিত না হয় এবং আপনি তাদের সাথে যা তৈরি করতে চান তার সাথে আপনার অনেক বেশি নমনীয়তা রয়েছে।
কোয়েল পাখির ডিম দিনে কয়টি খাওয়া যায়
দৃষ্টিশক্তি এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে আপনি সেদ্ধ, ভাজা বা কাঁচা আকারে সেবন করতে পারেন। কোয়েলের ডিম বেশি খাওয়ার ফলে রক্তে শর্করার মাত্রা কম এবং রক্তচাপ হতে পারে। আপনি আপনার খাদ্যের অংশ হিসাবে প্রতিদিন 3 থেকে 5টি কোয়েল ডিম খেতে পারেন।