আদার উপকারিতা, সাবধানতা এবং ব্যবহারবিধি
নিরামিষ হোক বা আমিষ আদা প্রায় সব রান্নাতেই সমানভাবে প্রয়োজন। এছাড়াও আদার বহু গুণ রয়েছে। বাজার থেকে কিনে এনে বা শুকনো পাউডার হিসাবে অথবা তেল বা জুস হিসাবে ব্যবহৃত হয় এই আদা।
প্রসেস ফুড ও কসমেটিক্সেও ব্যবহার হয়ে থাকে এই আদা।
আদার পুষ্টিগুণ
প্রতি ১০০ গ্রাম আদায় মিলবে ৭৯ ক্যালরি, ১৭.৮৬ কার্বোহাইড্রেট, ৩.৬ গ্রাম ভোজ্য আঁশ, ৩.৫৭ গ্রাম প্রোটিন, ৩৩ মিলিগ্রাম পটাশিয়াম, ১.১৫ গ্রাম লৌহ, ১৪ মিলিগ্রাম সোডিয়াম, ৭.৭ মিলিগ্রাম ভিটামিন সি।
এছাড়াও আছে ভিটামিন বি সিক্স, ম্যাগনেসিয়াম, দস্তা, ফসফরাস, রাইবোফ্লাবিন, নিয়াসিন এবং ফোলেট।
আদার পুষ্টিগুণের তালিকা (প্রতি ১০০ গ্রাম)
নিচের তালিকাটি আদার পুষ্টিগুণের মান উপস্থাপন করে, সেই সাথে কিছু অতিরিক্ত তথ্যও দেওয়া হল।
পুষ্টি উপাদান | পরিমাণ | দৈনিক চাহিদা মূল্য (%DV)* |
---|---|---|
ক্যালোরি | ৮০ কিলোক্যালোরি | ৪% |
মোট চর্বি | ০.৮ গ্রাম | ১% |
সোডিয়াম | ১৩ মিলিগ্রাম | ১% |
পটাসিয়াম | ৪১৫ মিলিগ্রাম | ৯% |
মোট কার্বোহাইড্রেট | ১৮ গ্রাম | ৬% |
ডায়েটারি ফাইবার | ২ গ্রাম | ৮% |
চিনি | ১.৭ গ্রাম | ২% |
প্রোটিন | ১.৮ গ্রাম | ৪% |
ভিটামিন সি | ৫ মিলিগ্রাম | ৬% |
লোহা | 0.6 মিলিগ্রাম | ৩% |
ম্যাগনেসিয়াম | ৪৩ মিলিগ্রাম | ১১% |
ভিটামিন বি 6 | 0.2 মিলিগ্রাম | ১০% |
দৈনিক চাহিদা মূল্য (DV) ২,০০০ ক্যালোরি মানের একটি খাদ্যের উপর ভিত্তি করে নির্ধারিত হয়েছে।
আদা খাওয়ার উপকারিতা
আদা আমাদের শরীরের জন্য খুবই উপকারী একটি খাদ্য। আদা খাওয়ার মাধ্যমে আমরা অনেক বড় বড় শারীরিক সমস্যা থেকে শুরু করে ছোটখাটো অনেক শারীরিক সমস্যা থেকে মুক্তি পেতে পারি।
চলুন জেনে আসা যাক আদা আমাদের শরীরে কি কি উপকার করে :
১. লোয়ার ব্লাড সুগারের মাত্রা কমায় : লোয়ার ব্লাড সুগারের মাত্রা কমায় আদা এবং টাইপ ২ ডায়াবেটিস রোগীদের একাধিক হৃদরোগের ঝুঁকি কমায়।
২. পিরিয়ডসের ব্যথা কমায়: পিরিয়ডসের ব্যথা কমাতে দারুণ কার্যকরী আদা। আদা দিয়ে চা খেলে ঋতুস্রাবের ব্যথা নিমিষে গায়েব হয়ে যায়।
৩. ক্যান্সার প্রতিরোধ করে: আদায় জিনজেরোল থাকায় তা ক্যান্সারের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলে।
৪. হজম শক্তি নিরাময় করে: গ্যাস, অম্বল, পেট ফাঁপার মতো সমস্যা প্রতিরোধ করতে দারুণ উপকারী আদা। যাঁদের হজমের সমস্যা রয়েছে, তাঁরা নিয়মিত সকালে খালি পেটে আদা খেলে উপকার পাবেন।
৫. বমি বমি ভাব কমায়: অনেকেরই সকালে ঘুম থেকে উঠে বমি বমি ভাব থাকে। যেটাকে মর্নিং সিকনেস বলে। এই বমি বমি ভাব দূর করতে আদার রস খুব উপকারি।
৬. শরীর ও মস্তিষ্ক গঠন করে: আদায় রয়েছে একাধিক পুষ্টি ও বায়োঅ্যাক্টিভ উপাদান যা শরীর ও মস্তিষ্কের গঠনে সহায়তা করে।
৭. হাঁপানি ও ফুসফুসে সংক্রমণ: ফুসফুসের ধমনিতে কোনো সংক্রমণ থাকলে এবং শ্বাস নিতে কষ্ট হলে অথবা হাঁপানি থাকলে প্রতিদিন দুবেলা এক চা–চামচ করে আদার রস, লেবুর রস, মধু এক কাপ গরম পানিতে মিশিয়ে চায়ের মতো করে খেলে এবং ঠান্ডাজাতীয় খাবার এড়িয়ে চললে ১৫ দিনের মধ্যে এর সুফল পাবেন
৮. হৃদ্রোগ : হৃদ্রোগের বিভিন্ন উপায় আছে প্রাকৃতিক উপায়ে নিরাময়ের জন্য।
যাঁদের হৃদ্রোগ আছে কিন্তু উচ্চরক্ত চাপ নেই, তাঁরা দুবেলা এক চা–চামচ করে আদার রস, লেবুর রস ও মধু এক কাপ গরম পানিতে মিশিয়ে চায়ের মতো করে খাবেন।
সেই সঙ্গে গ্যাসজনিত সমস্যা থাকলে সাত দিন এক চা–চামচ আদার রস গরম পানিতে মিশিয়ে চায়ের মতো করে ছয় থেকে সাতবার খাবেন।
ধৈর্যসহ নিয়মিত এ নিয়মে চললে হৃদ্রোগের সমস্যা দূর হতে থাকবে।
৯. মাইগ্রেন, সাইনাস, গলা ও মাথাব্যথায় : তাৎক্ষণিক সমাধানের জন্য সামান্য লবণ দিয়ে কাঁচা আদা চিবিয়ে খেতে হবে। কিন্তু রোগ সারাতে হলে প্রতিদিন দুবেলা এক চা–চামচ করে আদার রস, লেবুর রস ও মধু গরম এক কাপ পানিতে মিশিয়ে চায়ের মতো করে খেলে মাইগ্রেনের সমস্যা দূর হবে।
আহারে রুচি আসে, ক্ষুধা বাড়ায়, হজমে সহায়তা করে
সামান্য লবণ দিয়ে কাঁচা আদা চিবিয়ে খেলে আহারে রুচি আসে।
১০. কাশি কমায়, কফ দূর করে : প্রতিদিন দুবেলা এক চা–চামচ করে আদার রস, লেবুর রস ও মধু এক কাপ গরম পানিতে মিশিয়ে চায়ের মতো করে খেলে কাশি কমে, কফ দূর হয়।
১১.ওজন কমায়: আদায় রয়েছে উচ্চ মাত্রায় জিনজেরোল, যেটি অ্যান্টি-ইনফ্লেমটরি ও অ্যান্টিঅক্সিডেন্টের শক্তিশালী উপাদান।
প্রাণী ও মানুষের ওপর গবেষণা চালিয়ে দেখা গিয়েছে, আদা ওজন কমাতে সহায়তা করে। এটার মধ্যে রয়েছে শরীরের ওজন ও কোমর-পেটের ওজন ঠিক রাখার অনুপাত।
১২.রোগ প্রতিরোধে কার্যকর: আদার মধ্যে প্রচুর পরিমাণে অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট থাকে, যা আমাদের শরীরের রোগ প্রতিরোধ ব্যাপকভাবে সাহায্য করে।
১৩.আর্থারাইটিসে উপকারি: বেশ কিছু গবেষণায় উঠে এসেছে যে আদা আর্থারাইটিসের উপসর্গ কমিয়ে দেয়। বিশেষ করে যাঁদের হাঁটুতে আর্থারাইটিস দেখা দেয়।
১৪. টেস্টোস্টেরন: টেস্টোস্টেরন উৎপাদনে সাহায্য করে ।
আদা খাওয়ার অপকারিতা
আমাদের প্রতিদিনের রান্নার কাজেই প্রয়োজন হয় আদার। কারণ বেশিরভাগ রান্নার ক্ষেত্রে আদা ব্যবহার করা হয়। পরিচিত এই ভেষজের রয়েছে অনেক গুণ। রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে কাজ করে আদা।
নিয়মিত আদা খেলে যেকোনো অসুখের বিরুদ্ধে লড়াই করা সহজ হয়। তবে যেকোনো জিনিসেরই একটি পরিমাপ থাকে। অতিরিক্ত কোনোকিছুই ভালো নয়। উপকারী আদাও অতিরিক্ত খেলে দেখা দিতে পারে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া।
গর্ভবস্থায় আদা খাওয়া উচিত না এতে প্রিম্যাচিউর বাচ্চা হওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায়। আদা চা বেশি খাওয়া উচিত না এতে অনিদ্রা সমস্যা দেখা দিতে পারে।
জেনে নিন অতিরিক্ত আদা খাওয়ার অপকারিতা
অতিরিক্ত আদা খাবার কিছু অপকারিতা রয়েছে । তাই সাবধানতা অবলম্বন করা উচিত।
ডায়রিয়ার ঝুঁকি
খাবারে অনিয়ম করলে বাড়ে ডায়রিয়ার ঝুঁকি। এমনকী উপকারী খাবার অতিরিক্ত খেলেও এই সমস্যা হতে পারে। তাই খাবার গ্রহণের ক্ষেত্রে থাকতে হবে সতর্ক। আদা অতিরিক্ত খেলে তাও কিন্তু ডেকে আনতে পারে ডায়রিয়াকে। তাই আদা খাওয়া বা রান্নায় আদা ব্যবহারের ক্ষেত্রে পরিমাণের দিকে খেয়াল রাখুন।
হৃদযন্ত্রের সমস্যা
অতিরিক্ত আদা খাওয়ার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হিসেবে দেখা দিতে পারে হৃদযন্ত্রের গতি বেড়ে যাওয়ার মতো সমস্যা। এছাড়া ঝাপসা দষ্টিশক্তি, অনিদ্রাও হতে পারে আদা অতিরিক্ত খাওয়ার ফলে। এভাবে রক্তচাপের ওঠানামার ফলে হৃদরোগ দেখা দিতে পারে। তাই হৃদযন্ত্র ভালো রাখতে আদা খাওয়ার বিষয়ে সতর্ক হোন।
রক্তক্ষরণের ঝুঁকি
আদায় থাকে অ্যান্টিপ্লেটলেট বৈশিষ্ট্য। যে কারণে অতিরিক্ত আদা খেলে তা হতে পারে রক্তক্ষরণের কারণ। রসুন ও লবঙ্গের সঙ্গে আদা খেলে রক্তপাতের ঝুঁকি আরও বেড়ে যায়। তাই এ ধরনের সমস্যা এড়াতে অতিরিক্ত আদা খাওয়া থেকে বিরত থাকুন।
ত্বকে সমস্যা
ত্বকে সমস্যা সৃষ্টির জন্য বাইরের ধুলোবলি কিংবা রোদ তো দায়ী থাকেই, সেইসঙ্গে দায়ী থাকে আমাদের খাদ্যাভ্যাসও। যেমন ধরুন অতিরিক্ত আদা খাওয়ার কারণে চোখ ও ত্বকে দেখা দিতে পারে সংক্রমণ। হতে পারে ঠোঁট ফুলে ওঠা, গলায় অস্বস্তির মতো সমস্যাও। এমন ক্ষেত্রে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।
কতটুকু আদা খাবেন
দিনে ১.৫ মিলিগ্রাম আদা খেলেই যথেষ্ট। বিশেষ করে গর্ভবতী অবস্থায় এর বেশি আদা খাওয়ার কারণে দেখা দিতে পারে মিসক্যারেজের ঝুঁকি। তাই গর্ভাবস্থায় চিকিৎসকের পরামর্শ মেনে আদা খেতে হবে বা বাদ দিতে হবে।
আদা খাওয়ার নিয়ম
আদার সাহায্যে শারীরিক উপকার পাওয়ার জন্য আদা খাওয়ার কিছু নিয়ম রয়েছে। যে নিয়ম মাফিক খেলে আদার মাধ্যমে আমরা শরীরে অনেক শারীরিক উপকার পেতে পারি।
জেনে নিন আদা খাওয়ার নিয়ম গুলো
অনেকেই এক মাসের প্রয়োজনীয় আদা একবারে পিষে ফ্রিজে রেখে দেন। এ আদা দিয়ে কিন্তু ঔষধি উপকার পাওয়া যাবে না।
যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল সেন্টার ফর কমপ্লিমেন্টারি অ্যান্ড ইন্টিগ্রেটিভ হেলথের তথ্য অনুযায়ী, আদার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হিসেবে হজমে সমস্যা ও পেটফোলা ভাব দেখা দিতে পারে অতিমাত্রায় আদা খাওয়া হলে।
১. প্রতিটি উপাদানেরই নিজস্ব ডোজ থাকে, তেমনি আদার বেলায় ১৫ গ্রাম রস সারা দিনে খাওয়া উচিত। যাঁরা ডায়াবেটিসে ভুগছেন, তাঁরা মধু কম খাবেন।
২.আদা কাঁচা খেতে বেশি উপকার পাবে। যেমন আপনি চায়ের সঙ্গে আদা মিশিয়ে খেতে পারেন অথবা কাঁচাই চিবিয়ে খেতে পারেন। আদা কাঁচা খেলে বেশি উপকার পাওয়া যায়।
আদা সংরক্ষণ করার উপায়
অনেক সময়ে আদা কিনতে না পারলেও আপনি অনেকগুলো আদা একত্রে কিনে তা অনেক দিনের জন্য সংরক্ষণ করতে পারেন।
চলুন জেনে আসা যাক কিভাবে আপনি অনেকদিন আদা সংরক্ষণ করে রাখতে পারবেন
১. ফ্রিজে : আদা দীর্ঘদিন সতেজ রাখতে চাইলে খোসা সহ গোটা আদা ফ্রিজে রেখে দিতে পারেন। কোনো এয়ারটাইট কৌটা বা প্লাস্টিকের জিপ লক ব্যাগে ভরে ফ্রিজে রেখে দিন। এতে অনেক দিন পর্যন্ত ঠিক থাকবে। এ ছাড়া, আদা কাগজের ব্যাগে কিংবা পেপার টাওয়েলেও মুড়িয়ে ফ্রিজে রাখতে পারেন।
২. লেবুর রস: আদার খোসা ছাড়িয়ে এয়ার টাইট কৌটায় রাখুন। উপর থেকে ভিনেগার বা লেবুর রস ছড়িয়ে দিন। কৌটার ঢাকনা বন্ধ করে ফ্রিজে রেখে দিলে বেশ অনেক দিন আদা ফ্রেশ থাকবে। তবে খাওয়ার আগে এই আদার টুকরো ভালো করে ধুয়ে নেবেন।
পরিশেষে বলা যায়, আদার উপকারিতা যেমন আছে তেমনি অপরিকারিতাও আছে তবে নিয়ম মেনে আদা খেলে আদা আমাদের উপকারী করে। আদার অপকারিতার পরিমান সামান্য।