চুইঝালের উপকারিতা, খাওয়া এবং সংরক্ষণের নিয়ম
চুই ঝাল গাছ দেখতে পানের লতার মতো। পাতা কিছুটা লম্বা ও পুরু। পাতায় ঝাল নেই। এর কাণ্ড বা লতা কেটে ছোট টুকরো করে মাছ-মাংস রান্নায় ব্যবহার করা হয়। রান্নার পর এই টুকরো চুষে বা চিবিয়ে খাওয়া হয়। ঝাল স্বাদের হলেও চুইয়ের নিজস্ব স্বাদ ও ঘ্রাণ আছে।
দেশের দক্ষিণ পশ্চিমের খুলনা অঞ্চলের মসলা জাতীয় ফসল হিসেবে চুইঝালের কদর দেশজুড়ে। এসব অঞ্চলে এখন বাণিজ্যিকভাবেও চাষ করা হচ্ছে চুইঝালের। জিভে জল আনা চুই ঝালের মাংস খেয়েছেন অনেকে।
চুইঝালে দশমিক ৭ শতাংশ সুগন্ধি তেল থাকে। এছাড়াও এতে রয়েছে আইসোফ্লাভোন, অ্যালকালয়েড, পিপালারিটিন, পোপিরন, পোলার্টিন, গ্ইলাকোসাইডস, মিউসিলেজ, গ্লুকোজ, ফ্রুকটোজ, সিজামিন, পিপলাস্টেরল। চুই এর শিকড়ে রয়েছে ১৩.১৫ শতাংশ পিপারিন।
১০০ গ্রাম কাঁচা চুইঝালের প্রায়ক্ষিক পুষ্টি উপাদান এবং দৈনিক চাহিদার শতাংশ
চুইঝালের পুষ্টির তালিকা তৈরি করা একটু জটিল, কারণ বিভিন্নভাবে রান্না করলে এর পুষ্টিগুণের পরিবর্তন হয়। উপরন্তু, সঠিকভাবে চুইঝাল চেনার ক্ষেত্রে প্রায়ই বিভ্রান্তি দেখা যায়।
তবুও, আমরা চেষ্টা করছি ১০০ গ্রাম কাঁচা চুইঝালের বিভিন্ন পুষ্টি উপাদানের একটি সাধারণ ধারণা দেওয়ার, যো থেকে আপনি দৈনিক চাহিদার শতাংশের কিছুটা হিসেব করতে পারবেন।
পুষ্টি উপাদান | পরিমাণ | দৈনিক চাহিদার শতাংশ (প্রায়) |
---|---|---|
ক্যালোরি | ২০ (প্রায়) | ১% |
প্রোটিন | ১ গ্রামের বেশি | ২% |
চর্বি | নগণ্য | <১% |
ফাইবার | ১ গ্রামের বেশি | ৪-৫% |
ভিটামিন C | ৫০-১০০ মিলিগ্রাম | ৬৬%-১৩৩% |
ভিটামিন K | ৫০-১০০ মিক্রোগ্রাম | ৬০-১২০% |
ক্যালসিয়াম | ৮০ মিলিগ্রাম (প্রায়) | ৮% |
আয়রন | ১.৫-২ মিলিগ্রাম (প্রায়) | ৮-১১% |
পটাশিয়াম | ৩০০ মিলিগ্রামের বেশি | ৬% |
লক্ষণীয়
- চুইঝাল শাক রান্না করার ধরণের উপর নির্ভর করে এর পুষ্টিগুণের পরিমাণে পরিবর্তন ঘটতে পারে।
- এই শতাংশগুলো একটি ২০০০ ক্যালোরির ডায়েটের উপরে নির্ধারিত। বয়স, লিঙ্গ, এবং শারীরিক কর্মতৎপরতার উপর ভিত্তি করে এই দৈনিক চাহিদা আলাদা হতে পারে।
চুই ঝালের উপকারিতা
ঝাল হিসেবে সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হয় হাঁসের মাংস ও গরুর মাংস রান্নায়। মূলত, রান্নার জন্য চুইঝালের কান্ড ব্যবহার করা হয়।
আসুন এবার জেনে নিই চুই ঝালের উপকারিতা সমূহ
পাকস্থলীর সমস্যা দূরীকরণে
পাকস্থলী ও অন্ত্রের প্রদাহ দূর করে। তাছাড়া গ্যাস্ট্রিক ও কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করতে বিশেষ ভূমিকা পালন করে।
মানসিক প্রশান্তিতে
স্নায়ুবিক উত্তেজনা ও মানসিক অস্থিরতা প্রশমন করে।
ব্যথা দূর করতে
আমাদের শরীরের বিভিন্ন ধরনের ব্যথা দূর করে শরীর সতেজ রাখতে সহায়তা করে।
ঘুমের ঔষধ
এটি ঘুমের ঔষধ হিসেবে কাজ করে এবং শারীরিক দূর্বলতা কাটাতে সাহায্য করে।
প্রসব পরবর্তী ব্যথা প্রশমনে
সদ্য প্রসূতি মায়েদের শরীরের ব্যথা কমাতে চুইঝাল ম্যাজিকের মতো কাজ করে।
রুচি বাড়াতে
খাবারের রুচি বাড়াতে ও ক্ষুধামন্দা দূর করতে কার্যকর ভূমিকা পালন করে।
ক্যান্সার প্রতিরোধে
এতে প্রচুর পরিমাণ আইসোফ্লাভোন ও অ্যালকালয়েড নামক ফাইটোক্যামিকাল রয়েছে যা অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট হিসেবে কাজ করে এবং ক্যান্সার প্রতিরোধে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে।
হৃদরোগ প্রতিরোধে
দেহে কোলেস্টেরলের মাত্রা কমিয়ে এটি হৃদরোগ প্রতিরোধ করতে সাহায্য করে।
রোগ প্রতিরোধে
চুইঝাল বিভিন্ন ধরনের ব্যাকটেরিয়া ও ছত্রাকজনিত রোগ প্রতিরোধে সাহায্য করে।
চুইঝাল খাওয়ার নিয়ম
বেশিরভাগই মাংসের সাথে রান্না করে খাওয়া হয়, মাংস ছাড়াও বড় মাছ খিচুড়ি,ডাল মোট কথা ভারি পাকের প্রায় সব ধরনের তরকারির সাথে রান্না করে খাওয়া যায়।
খাওয়ার সময় ডাটার মতো চিবিয়ে চিবিয়ে খাওয়া হয়। দেশি চুইঝালের আঠালো স্বাদের ঝাঝালো স্বাদে বিমহিত হবে যে কেউ।
চুইঝাল সংরক্ষণের নিয়ম
চুইঝাল ছাল বাকলসহ পলিথিনে মুড়ে ডিপ ফ্রীজে রেখে দীর্ঘদিন পর্যন্ত খাওয়া যায়। তাছাড়া ফ্রীজে ছাড়াও চটের বস্তায় মুড়ে মাঝে মাঝে পানির ছিটা দিয়েও খাওয়া যায় বা কেটেকুটে ওয়াটার প্রুফ বক্সে ভরে ডিপ ফ্রীজে রেখেও খাওয়া যায়।
চুইঝাল রান্নার নিয়ম
মাংস ৬০ শতাংশ সেদ্ধ বা কষানো হয়ে গেলে তরকারিতে আলুর মতো করে কেটে দিয়ে দিতে হয়, তাতেই আসল দেশি চুইঝাল ভালোমতো সিদ্ধ হয়ে যায়।
চুইয়ের সামান্য ব্যবহার বদলে দেয় সম্পূর্ণ রান্নার স্বাদ। অসম্ভব লোভনীয় ইউনিক দেশি এ পণ্য একপিচ খেলে আপনাকে সারাজীবন মনে রাখতেই হয়।
চুইঝালের দাম
দক্ষিণপশ্চিমাঞ্চলের মানুষের কাছে গরুর মাংসের সাদ বাড়াতে ‘চুইঝাল অন্যতম একটি মসলা। আর চুইঝাল বিক্রির প্রধান মৌসুম কোরবানির ঈদ। সাধারণ সময়ে চুইঝাল কেজি প্রতি ৪০০ থেকে ৮০০ টাকা করে বিক্রি হলেও বর্তমানে চুইঝাল আকারভেদে বিক্রি হচ্ছে ৮০০ থেকে ১ হাজার ৫০০ টাকায়।
চুইঝাল গাছ লাগানোর পদ্ধতি
সাধারণত আম, সুপারিসহ কাঠ জাতীয় গাছের গোড়া থেকে ১২-১৫ ইঞ্চি দূরে গর্ত করে চুই গাছের কাটিং লাগাতে হয়। গর্তের মধ্যে কিছু গোবর, বর্জ্য, ৫০ গ্রাম ইউরিয়া, ৫০ গ্রাম টি এস পি, ৫০ গ্রাম পটাশ দিয়ে গর্তে ও মাটির সঙ্গে ভালোভাবে মিশিয়ে ৭ দিন রেখে কাটিং লাগাতে হবে।
উঁচু জায়গায় চুইঝালগাছ ভালো হয়। গোড়ায় পানি জমলে গাছ পচে যায়। গাছে ফুল-ফল হয়। বীজ থেকে চারাও হয়। তবে শিকড়সহ গিঁট কেটে লাগালে সহজে চারা হয়।
চুইঝাল গরু মাংসের রেসিপি
উপকরণ
- মাংস
- জিরা
- এলাচ
- মরিচের গুড়া
- দারুচিনি
- হলুদ
- আদা
- গরম মসলা
একটি প্যানে মাংস নিয়ে নিবেন। আপনি চাইলে খাসি বা গরু যে কোন মাংস নিতে পারেন। মাংসের টুকরো গুলো একটু বড় বড় করে কাটতে হবে। এবার একে একে সব মসলা দিয়ে দিতে হবে।
পিয়াজ ১ কাপ পরিমান , ২ – ৩ টুকরা দারুচিনি , তেজপাতা ৩ টি , ৫ – ৬ টি ছোট সাদা এলাচ , লং ৪ টি , গোল মরিচ ১০ – ১২ টি , শুকনো মরিচের গুড়ো ১ টেবিল চামচ , হলুদ ১ চা চামচ , ধনে গুড়ো ১ তেবিল চামচ , লবন ১ টেবিল চামচ , রসুন বাটা ১ টেবিল চামচ , আদা বাটা ১ টেবিল চামচ , যে কোন রান্নার তেল ১ কাপ পরিমান দিয়ে দিবেন।
সব গুলো মসলার সাথে মাংস খুব ভালো ভাবে উলটে পালটে মাখাতে হবে। এই মাখানোর উপরেই আসলে মাংসের আসল স্বাদ নির্ভর করে। মাংসটা যত ভালো করে মাখানো হবে স্বাদ তত বেড়ে যাবে। মাখানো হলে পানি দিয়ে দিতে হবে।
এমন ভাবে পানি দিতে হবে যেন পানিটা মাংসের গায়ে গায়ে থাকে , বেশি কম না হয়। এবার মাংসটা রান্না করতে হবে। এক দম ফুল আচেঁ তত ক্ষন রান্না করতে হবে ,
যত ক্ষন না পানিটা শুকিয়ে যায়। যখন পানি শুকিয়ে তেল উপরে উঠে আসবে না ততক্ষন রান্না করবেন । মাঝে মাঝে ঢাকনা খুলে নেড়ে দিতে হবে।
যখন মাংস গুলো নিচ থেকে উঠানো হবে তখন উপরের মাংস নিচে চলে যাবে। সব মাংস গুলো সমান তাপমাত্রায় চলে আসবে।
এবার বড় বড় ২৫০ গ্রাম রসুন নিতে হবে। রসুনের উপরের খোসা গুলো ফেলে দিবেন। কিন্তু গোড়া সব কেটে ফেলবেন না।
রসুনের উপর ছোলার একটা লেয়ার রাখতে হবে। এরপর রসুনের উপর চাকু দিয়ে চিরে দিতে হবে। এটি খেতেও কিন্তু অসাধারন লাগবে।
মাংসের তেল উপরে উঠে আসলে রসুন আর চুই ঝাল দিয়ে দিতে হবে। এবার আবার উপর নিচে ভালো ভাবে নাড়া চাড়া করতে হবে। মাংসটা কিন্তু অনবরত নাড়তে হবে। এই পর্যায় অনবরত না নাড়লে মাংসটা লেগে যেতে পারে।
এবার ঢাকা দিয়ে ৫ মিনিট অপেক্ষা করতে হবে। চুলোর আচঁ কিন্তু ফুল রাখতে হবে পুরো রান্নায়। ৫ মিনিট পর ঢাকনা খুলে মেথি গুড়ো দিয়ে দিতে হবে। এ ক্ষেত্রে কাচাঁ মেথি গুড়ো করে দিলেই হবে , ভেজে দিতে হবে না। আবার মাংস গুলো কষাতে হবে।
মাংস গুলো ততক্ষন কষাতে হবে যতক্ষন না রসুন গুলো সিদ্ধ হবে। এর পর ১ চা চামচ ভাজা জিরার গুড়ো , ১ চা চামচ রাধুনি গুড়ো , ১ চা চামচ গরম মসলা দিয়ে দিতে হবে। আবার নাড়া চাড়া দিয়ে কষিয়ে রান্না করতে হবে। এ ভাবেই আপনি মজাদার চুই ঝাল রান্না করতে পারবেন।
খুলনার চুইঝালের মাংসের সুখ্যাতি
চুইঝালের মাংস, শুনলেই যেন জিভে জল আসে। স্বাদে-ঘ্রাণে ও ঔষধি গুণে সমৃদ্ধ জনপ্রিয় মসলা চুইঝাল। এটি খেতে যেমন সুস্বাদু, তেমনি এর রয়েছে নানা উপকারিতা।
গরু, খাসি কিংবা হাঁসের মাংস চুইঝাল ছাড়া যেন জমেই না। মাংসের সঙ্গে চুইঝালের মিশেলে তরকারির স্বাদ হয়ে ওঠে লোভনীয়। এ জন্য খুলনার চুকনগর, জিরোপয়েন্টসহ নগরীর বিভিন্ন স্থানে গড়ে উঠেছে হোটেল-রেস্টুরেন্ট।
আর দূরদূরান্ত থেকে খুলনায় কেউ এলে একবার হলেও রেসিপির স্বাদ গ্রহণে ব্যাকুল হয়ে পড়ে। খুলনার জিরোপয়েন্টের কামরুলের হোটেলের বিক্রেতা শরীফ পোদ্দার ঢাকা পোস্টকে বলেন, হোটেলে মাছ, গরু ও খাসির মাংস বিক্রি হয়।
চুইঝাল দিয়ে গরুর মাংসের তরকারির জন্য হোটেলটি বিখ্যাত। এ মাংস খেতেই মানুষ এখানে বেশি আসে। হোটেলে রান্না করা দৈনিক ২ মণ মাংস বিক্রি করা হয়।
এতে ১৫ থেকে ২০ কেজি চুইঝাল প্রয়োজন হয়। চুইঝালের মাংসকে কেন্দ্র করে প্রথমে কামরুলের হোটেল এবং পরবর্তীতে ৪০টির মতো হোটেল ওই এলাকায় গড়ে উঠেছে বলে জানান শরীফ।
ক্রেতাদের কাছ থেকে প্রতি পিস মাংস ১৭০ টাকা এবং এক প্লেট ভাত ২০ টাকা নেওয়া হয়। সঙ্গে বিনামূল্যে পরিবেশন করা হয় ডাল। সব মিলে ১৯০-২০০ টাকায় একজন ভালোভাবে খেতে পারে।