বিলিরুবিনের মাত্রা কত হলে জন্ডিস হয়
জন্ডিস হলো এমন একটি চিকিৎসা পরিস্থিতি যখন রক্তে বিলিরুবিন নামক এক ধরনের পদার্থের মাত্রা অত্যধিক বৃদ্ধি পায়। বিলিরুবিন হলো রক্তের লোহিত কণিকা ভেঙে যাওয়ার পর প্রাকৃতিকভাবেই উৎপন্ন হওয়া এক ধরনের হলুদ রঙের রঞ্জক পদার্থ।
রক্তে বিলিরুবিনের মাত্রা ২ মিগ্রা/ডেসিলিটার ছাড়ালে সাধারণত জন্ডিসের লক্ষণ প্রকাশ পায়। তবে নবজাতক এবং প্রাপ্তবয়স্কদের ক্ষেত্রে এই মাত্রা ভিন্ন হতে পারে।
বিলিরুবিন হলো রক্তের লোহিত কণিকা ভেঙে যাওয়ার পর প্রাকৃতিকভাবেই উৎপন্ন হওয়া এক ধরনের হলুদ রঙের রঞ্জক পদার্থ।
সাধারণত লিভার রক্ত থেকে বিলিরুবিন অপসারণ করে এবং এটিকে পরিপাকতন্ত্রের মধ্য দিয়ে দেহ থেকে বের করে দেয়। কিন্তু, যখন লিভার সঠিকভাবে কাজ করে না বা পিত্তরসের স্বাভাবিক প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হয়, তখন এই পদার্থের মাত্রা বেড়ে গিয়ে জন্ডিসের লক্ষণ
বিলিরুবিনের মাত্রা
একজন সুস্থ মানুষের রক্তে বিলিরুবিনের মাত্রা নির্দিষ্ট পরিসীমার মধ্যে থাকে। যখন এই মাত্রা বেড়ে যায়, তখন জন্ডিস দেখা দেয়।
বিলিরুবিন কী
বিলিরুবিন হলো হলুদ রঙের এক ধরনের রঞ্জক পদার্থ যা পুরাতন লোহিত রক্তকণিকা ভেঙে যাওয়ার ফলে তৈরি হয়। লিভার এই বিলিরুবিনকে প্রক্রিয়া করে পিত্তরসে পরিণত করে এবং পরিপাকতন্ত্রের মাধ্যমে দেহ থেকে বের করে দেয়।
বিলিরুবিনের স্বাভাবিক মাত্রা
- সর্বমোট বিলিরুবিন: 0.2 থেকে 1.2 mg/dL (মাইক্রোগ্রাম প্রতি ডেসিলিটার)
- ডাইরেক্ট বা কনজুগেটেড বিলিরুবিন: 0.3 mg/dL এর নিচে I
বিভিন্ন ল্যাবরেটরিতে বিলিরুবিনের মাত্রার একক এবং স্বাভাবিক পরিসীমা কিছুটা ভিন্ন হতে পারে।
জন্ডিস কখন দেখা দেয়
- যখন রক্তে বিলিরুবিনের মাত্রা 2.5 mg/dL এর বেশি বেড়ে যায়।
- যখন লিভার সঠিকভাবে কাজ করে না এবং বিলিরুবিন রক্ত থেকে অপসারণ করতে পারে না।
- যখন পিত্তনালীতে বাধা থাকে এবং পিত্তরস পরিপাকতন্ত্রে প্রবেশ করতে পারে না।
জন্ডিসের লক্ষণ
- চোখ ও ত্বকের হলুদাভ ভাব I
- প্রস্রাবের রঙ গাঢ় হলুদ I
- মলের রঙ ফ্যাকাশে I
- ক্লান্তি I
- অবসাদ I
- ক্ষুধামান্দ্য I
- বমি বমি ভাব I
- চুলকানি I
বিলিরুবিনের মাত্রা বৃদ্ধির কারণ
- হেমোলাইটিক অ্যানিমিয়া: এই অবস্থায় লোহিত রক্তকণিকা দ্রুত ভেঙে যায় এবং রক্তে বিলিরুবিনের মাত্রা বেড়ে যায়।
- লিভারের রোগ: হেপাটাইটিস, লিভার সিরোসিস, লিভার ক্যান্সারের কারণে লিভারের কার্যক্ষমতা কমে যায় এবং বিলিরুবিনের মাত্রা বেড়ে যায়।
- পিত্তনালীর বাধা: পিত্তথলি, টিউমার, বা অন্য কোন কারণে পিত্তনালীতে বাধা সৃষ্টি হলে বিলিরুবিনের মাত্রা বেড়ে যায়।
বিলিরুবিনের মাত্রা কমে যাওয়ার কারণ
- অপুষ্টি I
- কিছু ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া I
- থ্যালাসেমিয়া I
বিলিরুবিন পরীক্ষা
রক্তে বিলিরুবিনের মাত্রা নির্ণয়ের জন্য বিভিন্ন পরীক্ষা করা হয়।
- সর্বমোট বিলিরুবিন পরীক্ষা: এই পরীক্ষা রক্তে মোট বিলিরুবিনের মাত্রা পরিমাপ করে।
- ডাইরেক্ট বিলিরুবিন পরীক্ষা: এই পরীক্ষা শুধুমাত্র লিভার দ্বারা সংযুক্ত বিলিরুবিনের মাত্রা পরিমাপ করে।
- ইউরিন বিলিরুবিন পরীক্ষা: বিলিরুবিন মূত্রে পাওয়া গেলে কিছু ধরণের লিভারের রোগ বা পিত্তনালীর বাধা নির্দেশ করতে পারে।
বিলিরুবিন পরীক্ষার তাৎপর্য
বিলিরুবিন পরীক্ষার ফলাফল জন্ডিসের ধরন এবং অন্তর্নিহিত কারণ নির্ধারণে সহায়তা করে। ডাইরেক্ট বিলিরুবিন বাড়লে লিভার বা পিত্তনালীর সমস্যার ইঙ্গিত হতে পারে। অন্যদিকে, মোট বিলিরুবিনের মাত্রা বাড়লে এবং ডাইরেক্ট বিলিরুবিন স্বাভাবিক থাকলে, তা হেমোলাইটিক অ্যানিমিয়া বা অন্য ধরণের রক্তের সমস্যার ইঙ্গিত দেয়।
অতিরিক্ত তথ্য
- শিশুদের মধ্যে, বিশেষ করে নবজাতকদের মধ্যে জন্ডিস খুবই সাধারণ। বেশিরভাগ সময় নবজাতকের জন্ডিস স্বাভাবিক ও অস্থায়ী এবং এক থেকে দুই সপ্তাহের মধ্যেই নিজে থেকেই সেরে যায়।
- বিলিরুবিন নিজে একটি হলুদ রঙের পদার্থ বলে, রক্তে এর মাত্রা বৃদ্ধি পেলে দেহের ত্বক এবং চোখের সাদা অংশ হলুদ দেখায়। লিভার যখন বিলিরুবিন প্রক্রিয়া করতে পারে না, তখন তা ত্বকের নিচে জমা হয়ে জন্ডিসের প্রধান লক্ষণটিকে সৃষ্টি করে।
- জন্ডিসের কোনো নির্দিষ্ট চিকিৎসা নেই। চিকিৎসা জন্ডিসের কারণের উপর ভিত্তি করে করা হয়।
গুরুত্বপূর্ণ অনুসরণীয়
- বিলিরুবিন পরীক্ষার ফলাফল সম্পর্কে বিস্তারিত ব্যাখ্যা জানতে একজন ডাক্তারের সাথে পরামর্শ করা অত্যাবশ্যক।
- যেকোনোপ্রকার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া এড়াতে পরীক্ষার পদ্ধতি সম্পর্কে আগে থেকে জেনে নেওয়া উচিত এবং ল্যাবরেটরির দেওয়া নির্দেশনা সঠিকভাবে অনুসরণ করা উচিত।
জন্ডিসের লক্ষণ প্রকাশে বিলিরুবিনের মাত্রা
জন্ডিসের লক্ষণগুলি সাধারণত রক্তে বিলিরুবিনের মাত্রা 2 থেকে 3 mg/dL এর বেশি বেড়ে গেলে স্পষ্টভাবে প্রকাশ পায়। তবে, ত্বকের রঙের উপর নির্ভর করে লক্ষণগুলির তীব্রতা ভিন্ন হতে পারে।
ফর্সা ত্বকের ক্ষেত্রে
- হালকা হলুদাভ আভা, বিশেষ করে চোখের সাদা অংশে (স্ক্লেরা) এবং মুখের ভেতরের অংশে (শ্লেষ্মা)
- প্রস্রাবের রঙ গাঢ় হলুদ I
- মলের রঙ ফ্যাকাশে I
শ্যামবর্ণ ত্বকের ক্ষেত্রে
- হলুদাভ আভা কম স্পষ্ট হতে পারে I
- প্রস্রাবের রঙ গাঢ় হলুদ I
- মলের রঙ ফ্যাকাশে I
অন্যান্য লক্ষণ
- ক্লান্তি I
- অবসাদ I
- ক্ষুধামান্দ্য I
- বমি বমি ভাব I
- চুলকানি I
- পেটে ব্যথা I
- জ্বর I
বিলিরুবিনের মাত্রা এবং লক্ষণের তীব্রতা
রক্তে বিলিরুবিনের মাত্রা বৃদ্ধির সাথে সাথে জন্ডিসের লক্ষণগুলি আরও তীব্র হতে পারে।
- 2-3 mg/dL: হালকা হলুদাভ আভা, প্রস্রাবের রঙ গাঢ় হলুদ I
- 3-4 mg/dL: ত্বক ও চোখের সাদা অংশে স্পষ্ট হলুদাভ আভা, মলের রঙ ফ্যাকাশে I
- 4-5 mg/dL: তীব্র হলুদাভ আভা, ক্লান্তি, অবসাদ, ক্ষুধামান্দ্য I
- 5 mg/dL এর বেশি: তীব্র হলুদাভ আভা, বমি বমি ভাব, চুলকানি, পেটে ব্যথা, জ্বর I
গুরুত্বপূর্ণ বিষয়
- জন্ডিসের লক্ষণ দেখা দিলে দ্রুত একজন ডাক্তারের সাথে পরামর্শ করা উচিত।
- ডাক্তার রোগীর ত্বকের রঙ, লক্ষণ এবং অন্যান্য পরীক্ষার ফলাফলের উপর ভিত্তি করে জন্ডিসের কারণ নির্ণয় করবেন।
- জন্ডিসের কারণ নির্ণয়ের পর ডাক্তার উপযুক্ত চিকিৎসা প্রদান করবেন।
বিশেষ দ্রষ্টব্য
- নবজাতকদের মধ্যে জন্ডিস খুবই সাধারণ। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এটি স্বাভাবিকভাবেই চলে যায়।
- তবে, নবজাতকের মধ্যে জন্ডিসের লক্ষণ দেখা দিলে শিশুরোগ বিশেষজ্ঞের সাথে পরামর্শ করা উচিত।
জন্ডিসের ধরন এবং বিলিরুবিন
জন্ডিস হলো ত্বক, চোখের সাদা অংশ এবং মুখের ভেতরের অংশে হলুদাভ আভা দেখা দেওয়ার একটি অবস্থা। এটি রক্তে বিলিরুবিনের মাত্রা বৃদ্ধির কারণে হয়। বিলিরুবিন হলো পুরাতন লোহিত রক্তকণিকা ভেঙে যাওয়ার ফলে তৈরি একটি হলুদ রঙের পদার্থ।
জন্ডিসের ধরন
জন্ডিসকে মূলত তিন ভাগে ভাগ করা যায়:
প্রি-হেপাটিক জন্ডিস
এই ধরনের জন্ডিসে রক্তে অসংযুক্ত বা ইনডাইরেক্ট বিলিরুবিনের মাত্রা প্রধানত বেড়ে যায়।
কারণ
- হেমোলাইটিক অ্যানিমিয়া: যখন লোহিত রক্তকণিকা দ্রুত ভেঙে যায়।
- গ্লুকোজ-6-ফসফেট ডিহাইড্রোজেনেস (G6PD) এর অভাব: এটি একটি জিনগত রোগ যা লোহিত রক্তকণিকাকে ভেঙে ফেলতে পারে।
লক্ষণ
- ত্বক ও চোখের সাদা অংশে হলুদাভ আভা I
- প্রস্রাবের রঙ গাঢ় হলুদ I
- মলের রঙ ফ্যাকাশে I
- ক্লান্তি I
- অবসাদ I
- ক্ষুধামান্দ্য I
চিকিৎসা
- অন্তর্নিহিত কারণের উপর নির্ভর করে।
- হেমোলাইটিক অ্যানিমিয়ার ক্ষেত্রে, রক্ত সঞ্চালন বা অন্যান্য চিকিৎসা প্রয়োজন হতে পারে।
- G6PD এর অভাবের ক্ষেত্রে, রোগীদের জীবাণুনাশক ওষুধ এড়িয়ে চলতে হবে।
হেপাটিক জন্ডিস
- এই ধরনের জন্ডিসে রক্তে উভয় প্রকার বিলিরুবিনের (সংযুক্ত ও অসংযুক্ত) মাত্রাই বেড়ে যায়।
কারণ
- ভাইরাল হেপাটাইটিস: লিভারের প্রদাহ I
- লিভার সিরোসিস: লিভারের ক্ষতি I
- অ্যালকোহলিক লিভার ডিজিজ I
- ওষুধের বিষক্রিয়া I
লক্ষণ
- প্রি-হেপাটিক জন্ডিসের লক্ষণগুলির সাথে I
- বমি বমি ভাব I
- বমি I
- পেটে ব্যথা I
- জ্বর I
- ওজন কমানো I
চিকিৎসা
- অন্তর্নিহিত কারণের উপর নির্ভর করে।
- ভাইরাল হেপাটাইটিসের ক্ষেত্রে, অ্যান্টিভাইরাল ওষুধ প্রয়োজন হতে পারে।
- লিভার সিরোসিসের ক্ষেত্রে, লিভার ট্রান্সপ্ল্যান্ট প্রয়োজন হতে পারে।
পোস্ট-হেপাটিক জন্ডিস
- এই ধরনের জন্ডিসে প্রধানত সংযুক্ত বা ডাইরেক্ট বিলিরুবিনের মাত্রা বেড়ে যায়।
কারণ
- পিত্তথলিতে পাথর I
- পিত্তনালীতে টিউমার I
বিলিরুবিন পরীক্ষা
জন্ডিস হলো ত্বক, চোখের সাদা অংশ এবং মুখের ভেতরের অংশে হলুদাভ আভা দেখা দেওয়ার একটি অবস্থা। এটি রক্তে বিলিরুবিনের মাত্রা বৃদ্ধির কারণে হয়। বিলিরুবিন হলো পুরাতন লোহিত রক্তকণিকা ভেঙে যাওয়ার ফলে তৈরি একটি হলুদ রঙের পদার্থ।
রক্তে বিলিরুবিনের মাত্রা নির্ধারণের জন্য দুটি ধরনের পরীক্ষা করা হয়:
সর্বমোট বিলিরুবিন
- এই পরীক্ষা রক্তে সামগ্রিকভাবে উপস্থিত সমস্ত বিলিরুবিনের (সংযুক্ত এবং অসংযুক্ত) মাত্রা পরিমাপ করে।
- স্বাভাবিক পরিসীমা: 0.2 – 1.2 mg/dL (মাইক্রোগ্রাম প্রতি ডেসিলিটার)
উচ্চ মাত্রার কারণ
- হেমোলাইটিক অ্যানিমিয়া I
- লিভারের রোগ I
- পিত্তনালীর বাধা I
নিম্ন মাত্রার কারণ
- অপুষ্টি I
- কিছু ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া I
- থ্যালাসেমিয়া I
ডাইরেক্ট বিলিরুবিন
- এই পরীক্ষা শুধুমাত্র লিভার দ্বারা সংযুক্ত বিলিরুবিনের মাত্রা পরিমাপ করে।
- স্বাভাবিক পরিসীমা: 0 – 0.3 mg/dL I
উচ্চ মাত্রার কারণ
- লিভারের রোগ I
- পিত্তনালীর বাধা I
নিম্ন মাত্রার কারণ
- হেমোলাইটিক অ্যানিমিয়া I
বিলিরুবিন পরীক্ষার ফলাফল
সর্বমোট বিলিরুবিন
- বৃদ্ধি: জন্ডিসের ইঙ্গিত I
- স্বাভাবিক: জন্ডিস নেই I
ডাইরেক্ট বিলিরুবিন
- বৃদ্ধি: লিভার বা পিত্তনালীর সমস্যার ইঙ্গিত I
- স্বাভাবিক: লিভার বা পিত্তনালী সঠিকভাবে কাজ করছে I
বিলিরুবিন পরীক্ষা সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য
- পরীক্ষার আগে রাতে উপোস করা বাধ্যতামূলক নয়।
- পরীক্ষাটি খুবই সহজ এবং বেদনাহীন।
- ফলাফল সাধারণত কয়েক ঘন্টার মধ্যে পাওয়া যায়।
- বিলিরুবিন পরীক্ষার ফলাফলের ব্যাখ্যা করতে একজন ডাক্তারের সাথে পরামর্শ করা অত্যাবশ্যক।
গুরুত্বপূর্ণ অনুসরণীয়: ডাক্তারের পরামর্শ ব্যতীত জন্ডিসের লক্ষণ দেখা দিলে নিজে থেকে কোনো ওষুধ সেবন করবেন না।
গুরুত্বপূর্ণ দাবিত্যাগ: এই প্রবন্ধটি শুধুমাত্র তথ্যের উদ্দেশ্যে এবং একটি যোগ্যতাসম্পন্ন স্বাস্থ্যসেবা পেশাদারের পরামর্শের বিকল্প হিসেবে ব্যবহার করা উচিত নয়। সিরোসিসের লক্ষণ বা অন্যান্য স্বাস্থ্য সমস্যা থাকলে দয়া করে, অবিলম্বে আপনার ডাক্তারের সাথে পরামর্শ করুন।