রুই মাছের পুষ্টিগুণ, উপকারিতা এবং অপকারিতা
রুই মাছ ভারত, পাকিস্তান, বাংলাদেশ ও মায়ানমারের নদীতন্ত্রের প্রাকৃতিক প্রজাতি। মিষ্টি জলের পুকুর, হ্রদ, নদী ও মোহনায় পাওয়া যায়। বাংলাদেশে বিভিন্ন বড় নদীতে বিচরণ করে, ডিম ছাড়ার সময় প্লাবন ভূমিতে প্রবেশ করে।
স্বাদ, সহজ চাষপদ্ধতি ও অর্থনৈতিক গুরুত্বের কারণে ও পুষ্টি ঘাটতি মেটাতে শ্রীলঙ্কা, চীন, রাশিয়া, জাপান, ফিলিপাইন, মালয়েশিয়া এবং আফ্রিকান দেশগুলোতে রুই মাছের চাষ হচ্ছে।
আন্দামান দ্বীপপুঞ্জের মিষ্টি জলের নদীতেও অনুপ্রবেশিত রুইয়ের সফল চাষ হচ্ছে। হলদা নদী কে রুই মাছের অভয়ারণ্য হিসেবে দেখা যায়।
রুই মাছ শাকাশী। এরা সাধারণত জলের মধ্যস্তরে চলাচল করে৷ এদের মুখ কিছুটা নিচের দিকে নামানো এবং পুরু ঠোঁট থাকার কারণে জলজ উদ্ভিদ, আগাছা এবং মাঝে মাঝে জলের তলদেশ থেকে পঁচা জৈব পদার্থ খেয়ে জীবনধারণ করে৷
এছাড়াও ফিসমিল, খৈলের গুঁড়া, কুঁড়া ইত্যাদি পুকুরে চাষের সময় সম্পূরক খাদ্য হিসাবে ব্যবহার করা হয়। তবে ছোট অবস্থায় এদের প্রধান খাদ্য থাকে প্রাণীকণা বা প্লাংকটন।
রুই মাছ পুষ্টিগুণ
এ মাছ খেতে খুবই সুস্বাদু। গবেষণায় দেখা গিয়েছে, ৯.৫৬ শতাংশ, জলীয় অংশ ৭৪.৬ শতাংশ, ক্যালসিয়াম ৬৫০ মিলিগ্রাম, পটাশিয়াম ২৮৮ মিলিগ্রাম, সোডিয়াম ১০১ মিলিগ্রাম, কলিন ৮১৯ মিলিগ্রাম, ভিটামিন সি এম সি জি, ফসফরাস, আয়রন ইত্যাদি পাওয়া যায়।
এর তাপমূল্য ৯৭ ক্যালরী। খাওয়ার তিন ঘন্টার মধ্যে হজম হয় এই মাছ। এ ছাড়া এ মাছ নিয়মিত গ্রহণ পুষ্টির ঘাটতি পূরণ,দৃষ্টি শক্তি বৃদ্ধি, জয়েন্টের কর্মসঞ্চলতা বৃদ্ধি, হার্ট চাঙ্গা রাখা,রক্ত প্রবাহের উন্নতি, ত্বকের সৌন্দর্য বৃদ্ধি সহ নানা কাজ করে।
১০০ গ্রাম রান্না রুই মাছে পুষ্টি উপাদান এবং দৈনিক চাহিদার শতাংশ
নির্দিষ্টভাবে বলতে গেলে এটা নির্ভর করে মাছটি রান্না করার পদ্ধতির উপর। তবেুও, আমরা ১০০ গ্রাম রান্না করা রুই মাছের (ভাজা বা তেল ছাড়া রান্না) সাধারণ পুষ্টির তালিকা দেওয়ার চেষ্টা করতে পারি।
এ থেকেআপনিদৈনিক চাহিদার শতাংশের কিছুটা হিসেব করতে পারবেন।
পুষ্টি উপাদান | পরিমাণ (প্রায়) | দৈনিক চাহিদার শতাংশ (প্রায়) |
---|---|---|
ক্যালোরি | ১৮০-২২০ | ৯-১১% |
প্রোটিন | ২০-২৫ গ্রাম | ৪০-৫০% |
চর্বি | ৮-১২ গ্রাম | ১২-১৮% |
স্যাচুরেটেড ফ্যাট | ১.৫ – ২.৫ গ্রাম | ৭.৫-১২.৫% |
ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিড | ০.৫-১ গ্রাম | কিছুটা |
ক্যালসিয়াম | ৫০ মিলিগ্রাম | ৫% |
আয়রন | ১.৫ মিলিগ্রাম | ৮.৩৩% |
ভিটামিন D | ৫-১০ মিক্রোগ্রাম | ২৫-৫০% |
ভিটামিন B12 | ৩-৫ মিক্রোগ্রাম | ১২৫-২০৮% |
লক্ষণীয়:
- রুই মাছ রান্না করার পদ্ধতির (ভাজা, ঝোল ইত্যাদি) উপর নির্ভর করে এর পুষ্টিগুণের মাত্রায় যথেষ্ট নয়-ফের হতে পারে।
- এই শতাংশগুলো একটি ২০০০ ক্যালোরির ডায়েটের উপরে নির্ধারিত। বয়স, লিঙ্গ, এবং শারীরিক কর্মতৎপরতার উপর ভিত্তি করে এই দৈনিক চাহিদা আলাদা হতে পারে।
রুই মাছ বাহ্যিক গঠন
রুই মাছের দেহ অনেকটা মাকু আকৃতির। মাথা ও লেজ ক্রমশ সরু। প্রস্থ থেকে উচ্চতা বেশি। চলনের সময় জলের ভেতর গতি বাধাপ্রাপ্ত হয় না বলে এ ধরনের আকৃতিকে “স্ট্রিমলাইনড” বলে। শরীরের দুপাশ সমানভাবে চ্যাপ্টা এবং সারা শরীর রূপালী আঁশ দিয়ে আবৃত থাকে।
আঁশগুলো মসৃণ ও সারিবদ্ধ ভাবে সাজানো থাকে। ধূসর বর্ণের পাখনার এই মাছের পৃষ্ঠদেশের আঁশের কেন্দ্র লালাভ এবং প্রান্ত কালো বর্ণের হয়ে থাকে। আঁশের কেন্দ্রের এই লালাভ বর্ণ প্রজনন ঋতুতে আরও গাঢ় ও উজ্জ্বল হয়। এছাড়াও অধিক জলজ উদ্ভিদময় পরিবেশে বেড়ে ওঠা মাছের পৃষ্ঠদেশের বর্ণ লালাভ-সবুজ হতে পারে।
এদের পিঠ ও পিঠের নিচের দিকটা বাদামি রঙের এবং পেট রুপালি সাদা রঙের হয়৷ মুখ নিচের দিকে নামানো থাকে এবং পুরু ঠোট ভিতরের দিকে ভাঁজ হয়ে থাকে৷
মুখের উপরে ঠোঁটে এক জোড়া গোঁফ থাকে। রুই মাছ সর্বোচ্চ ২০০ সেমি পর্যন্ত লম্বা হতে পারে। এরা সর্বোচ্চ ১০ বছর পর্যন্ত বাঁচতে পারে এবং ওজন ৪৫ কেজি পর্যন্ত হতে পারে বলে জানা গেছে।
রুই মাছ চাষ পদ্ধতি
রুই মাছ দেশি ও কার্প জাতীয় মাছের সাথে মিশ্র চাষ করা যায়। রুই মাছ পানির মধ্যস্তরে থাকার কারণে পানি উপরের স্তরের মাছ যেমন কাতল এবং নিচের স্তরের মাছ যেমন কালো কার্পের সাথে চাষ করা এতে খাদ্য খরচ কম হয়।
মাছ চাষের পূর্বে পুকুর প্রস্তত করতে হয়।পুকুর প্রস্তত করার পর পুকুরে পানি মজুদ করে একটি নির্দিষ্ট আকারের রুই মাছের পোনা ছাড়তে হয়। পানির গুণাগুণ ঠিক রেখে মাছের মোট ওজনের ৩-৫ শতাংশ সম্পূরক খাবার দৈনিক ২-৩ বারে দিতে হয়।
সম্পূরক খাবার তৈরির জন্য সাধারণত ফিসমিল,চালের কুড়া, সরিষার খৈল,ফিস গ্রোয়ার সহ বিভিন্ন উপকরণ ব্যবহার করা হয়। ৬ মাসের পর থেকেই এই মাছ খাওয়া ও বাজারজাত করা যায় এবং বাজারে বেশ চাহিদা আছে।
রুই মাছের উপকারিতা
রুই মাছের স্বাদ নিয়ে নতুন করে বলার কিছুই নেই। তবে রুই মাছ যদি রোজ খাওয়া হয়, জানেন কী হতে পারে। শরীরের ওপর ঠিক কেমন প্রভাব পড়ে এই মাছের।
রক্ত বাঁধার সমস্যা কমে
করোনার পর থেকে অনেকের শরীরেই রক্ত জমাট বাঁধার সমস্যা দেখা দিচ্ছে। এই সমস্যা কমাতে রুইমাছ দারুণ কার্যকর। এই মাছ নিয়মিত খেলে রক্তপ্রবাহ কিছুটা বাড়তে শুরু করে।
এর ফলে ইকোসোনোয়েড নামক হরমোনের মাত্রা কমে। এটি রক্ত জমাট বাঁধার অন্যতম কারণ। রুই মাছ নিয়মিত খেলে এই হরমোনের প্রভাব কমে, তাই রক্ত জমাটের আশঙ্কাও কমে।
ত্বকের নানা রকম সংক্রমণ দূর হয়
ত্বকের নানা রকম সংক্রমণ বা প্রদাহের সমস্যাও কমতে পারে নিয়মিত এই মাছ খেলে। এই মাছে থাকা ওমেগা থ্রি ফ্যাটি অ্যাসিড ত্বককে নানা সংক্রমণের হাত থেকে রক্ষা করতে পারে।
চোখ ভাল রাখে
এই ওমেগা থ্রি ফ্যাটি অ্যাসিডের আরও কিছু গুণ রয়েছে। এখন অনেককেই সারা দিন কম্পিউটারের সামনে কাটাতে হয়। তা ছাড়া স্মার্টফোন তো আছেই। এগুলির আলো চোখের উপর নানা ধরনের প্রভাব ফেলে।
দৃষ্টিশক্তি কমে যায়, চোখ শুকিয়ে যায়। চোখের এই ধরনের সমস্যা কমতে পারে রোজ রুই মাছ খেলে। ওমেগা থ্রি ফ্যাটি অ্যাসিড চোখের বহু সমস্যাকে প্রতিহত করে।
হাড়ের সমস্যা কিছুটা দূর করে
যাঁরা হাড়ের ব্যথায় ভোগেন, তাঁরা রোজ এই মাছ খেলে সমস্যা কমতে পারে। এর কিছু উপাদান হাড়ের সংযোগস্থল নমনীয় করে তোলে। ফলে ব্যথা কমে।
রুই মাছের অপকারিতা
রুই মাছ আমাদের সবার ক্ষেত্রেই স্বাস্থ্যকর। এই মাছের তেমন কোন অপকারিতা নেই বললেই চলে। তবে অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায় মাছ টি কোন পচা বা দূষিত জলের থাকলে বা আবর্জনা বা কীটনাশক মিশ্রিত জলের হয়ে থাকলে, সে ক্ষেত্রে ওই মাছ খেলে আমাদের পেটের বিভিন্ন রকম সমস্যা হতে পারে।
তাই মাছ কেনার সময় তাজা দেখে কেনার চেষ্টা করবেন। কিছু লোকের আবার এলার্জির মতো সমস্যা দেখা গেছে রুই মাছ খাওয়ার পর।
রুই মাছের দোপেয়াজা
উপকরন
- হলুদ গুঁড়া ১/২ চা চামচ
- মরিচ গুঁড়া ১/২ চা চামচ
- লবন ১/২ চা চামচ
- পেঁয়াজ কুঁচি ১ ১/২ কাপ
- রসুন কুঁচি ১ চা চামচ
- কাঁচা মরিচ ২ টি (ফালি করা)
- আদা বাটা ১/২ চা চামচ
- রসুন বাটা ১/২ চা চামচ
- হলুদ গুঁড়া ১/২ চা চামচ
- মরিচ গুঁড়া ১ চা চামচ
- জিরা গুঁড়া ১/২ চা চামচ
- ধনিয়া গুঁড়া ১/২ চা চামচ
- লবন পরিমানমত
- টমেটো ১ টি
- ধনিয়া পাতা কুঁচি ১/৪ কাপ
- কুসুম গরম পানি ১ ১/২ কাপ
- তেল ১/৩ কাপ
- রুই মাছ ৪ টুকরা
নির্দেশনা
মাছ ভাল করে পরিস্কার করে ধুয়ে পানি ঝরিয়ে নিন। মাছের গায়ে কোন পানি থাকা যাবেনা। এখন মাছের সাথে ১/২ চা চামচ লবন, ১/২ চা চামচ হলুদ এবং ১/২ চা চামচ মরিচ গুঁড়া দিয়ে মেখে রাখুন।
প্যানে তেল নিয়ে চুলায় গরম হতে দিন। তেল গরম হয়ে গেলে মশলা মাখা মাছ দিয়ে দিন। এখন চুলার আঁচ মাঝারি করে দিয়ে মাছের দুপিঠ লালচে করে ভেঁজে নিন।
মাছ ভাঁজা হয়ে গেলে মাছগুলো আলাদা প্লেটে তুলে রেখে দিন। এখন এই তেলে একে একে রসুন কুঁচি, পেঁয়াজ এবং কাঁচা মরিচ ফালি দিয়ে দিন।
পেঁয়াজের কালার হালকা বাদামী হয়ে গেলে এর মধ্যে আদা বাটা এবং রসুন বাটা দিয়ে সামান্য পানি দিয়ে দিন।
সব একসাথে ভাল করে নেড়ে দিয়ে একে একে হলুদ, মরিচ গুঁড়া, জিরা গুঁড়া, ধনিয়া গুঁড়া এবং পরিমানমত লবন দিয়ে ভালকরে কষিয়ে রান্না করুন।
চুলার আঁচ মাঝারি রেখে মশলায় অল্প অল্প পানি দিয়ে কষাতে হবে। মোট ১ কাপ পানি অল্প অল্প করে দিয়ে মশলা কষিয়ে নিন।
মশলা কষানো হয়ে গেলে মশলার উপর তেল উঠে গেলে ভাঁজা মাছগুলো দিয়ে দিন। এক মিনিট পর মাছ সাবধানে উলটে দিয়ে মাছে বাকি ১/২ কাপ পানি দিয়ে পাত্র ঢেকে দিন।
মাঝারি আঁচে মাছ ঢেকে ৫-৭ মিনিট রান্না করুন যাতে মাছের ভিতর ভালভাবে মশলা প্রবেশ করে। পাঁচ থেকে সাত মিনিট পর পাত্রের ঢাকনা তুলে মাছের উপর টুকরো করে রাখা টমেটো এবং ধনিয়া পাতা কুঁচি দিয়ে দিন।
মাছের ঝোলের উপর তেল উঠে এলে চুলা বন্ধ করে দিয়ে মাছ তিন থেকে চার মিনিট ঢেকে রেখে দিন। এরপর পরিবেশন করুন গরম গরম ভাতের সাথে মজাদার রুই মাছের দোপেয়াজা।
রুই পোস্ত
উপকরণ
বড় রুইমাছ ৬-৭টা পিস, পোস্ত বাটা১০০ গ্রাম টমেটো কুচানো১ কাপ, কালো জিরাসামান্য টমেটো সস্ ৪ চামচ, কাঁচা লঙ্কা চেরা ৪-৫টি কাশ্মিরি লঙ্কার গুঁড়ো ১চামচ, নুন পরিমাণ মতো, চিনি সামান্য, হলুদ পরিমান মতো ধনেপাতা কুচানো ৩ চামচ, সরিষার তেল ১৫০ গ্রাম জল১ কাপ
পদ্ধতি
প্রথমে রুইমাছের টুকরোগুলি ভালো করে ধুয়ে নুন হলুদ মাখিয়ে নিন। কড়াইতে সরষের তেল দিয়ে গরম করে রুই মাছগুলোকে ভালো করে ভেজে তুলে নিন।
এবার কড়াইতে বাকি তেলের মধ্যে কালো জিরা ফোড়ন দিন। তাতে টমাটো কুচানো ও সামান্য হলুদ দিয়ে ভালো করে নাড়াচাড়া করুন। এতে টমাটো সস্ ঢেলে দিয়ে আবার ভালো করে নাড়াচাড়া করুন।
এর মধ্যে পোস্ত বাটা, কাঁচা লঙ্কা চেরা, কাশ্মিরি লঙ্কার গুঁড়ো, নুন সামান্য এবং সামান্য চিনি দিয়ে ভালো করে নাড়াচাড়া করে জল ঢেলে দিন।
ভাজা রুই মাছগুলোকে এর মধ্যে দিয়ে ১০ মিনিট ভালো করে ফুটতে দিন। একটু মাখামাখা হলে ধনেপাতা কুচানো দিয়ে নাড়াচাড়া করে নামিয়ে নিলেই রুই পোস্ত তৈরী।