অশ্বগন্ধার উপকারিতা, অপকারিতা এবং ব্যবহারবিধি
আয়ুর্বেদে অশ্বগন্ধাকে একটি শক্তিশালী ভেষজ হিসাবে সংজ্ঞায়িত করে। আয়ুর্বেদে ব্রহ্মাস্ত্র হয়ে উঠেছে এই অশ্বগন্ধা। বাংলার এই নিজস্ব ভেষজ আমেরিকা, ব্রিটেন, দক্ষিণ আফ্রিকা সহ একাধিক দেশে এর খ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছে।
একাধিক সংস্থা এই বাংলার অশ্বগন্ধাকে কাজে লাগিয়ে একাধিক ঔষধ তৈরি করেছে। বলা হয় যে এটি কেবল ব্যথা এবং প্রদাহ কমায় না, তবে অনিদ্রার চিকিৎসা এবং সামগ্রিক স্বাস্থ্যকে বাড়িয়ে তুলতেও সহায়তা করতে পারে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, বাতের ব্যথা, অনিদ্রা বা বার্ধক্যজনিত সমস্যা নিরাময়ে অশ্বগন্ধার বিকল্প নেই। এমনকি যৌবন ধরে রাখতে হলে অশ্বগন্ধার উপকারিতা অনস্বীকার্য।
ত্বকের সমস্যাতেও দারুণ উপকারী। করোনাকালে মানুষ নির্ভর করতে শুরু করেছে ভেষজ গুণসমৃদ্ধ অশ্বগন্ধার উপর।
অশ্বগন্ধাের পুষ্টিগুণের তথ্য
অশ্বগন্ধা ঐতিহ্যবাহী ঔষধে দীর্ঘদিনের ব্যবহারের ইতিহাস থাকলেও, এর পুষ্টিগুণের মান খুঁজে পেতে কয়েকটি বিষয় লক্ষ্য করা জরুরি:
- সীমিত এবং পরিবর্তনশীল তথ্য: অশ্বগন্ধা (মূল, পাতা ইত্যাদি) এর সঠিক পুষ্টিগুণের বিশ্লেষণ সম্পর্কিত নির্ভরযোগ্য বৈজ্ঞানিক গবেষণা তুলনামূলকভাবে সীমিত। এর উপাদানগুলি চাষের অবস্থা, প্রক্রিয়াজাতকরণ পদ্ধতি এবং উদ্ভিদের নির্দিষ্ট অংশ ব্যবহারের উপর ভিত্তি করে পরিবর্তিত হতে পারে।
- সক্রিয় যৌগ উপাদানের উপর গুরুত্বারোপ: গবেষণা বেশিরভাগ সময় অশ্বগন্ধায় পাওয়া ‘withanolides’ (withanolides) নামক সক্রিয় যৌগের উপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করে, যা সম্ভাব্য স্বাস্থ্য উপকারিতার জন্য দায়ী বলে বিশ্বাস করা হয়।
অশ্বগন্ধা রুট পাউডারের সাধারণ পুষ্টি প্রোফাইল (প্রায় প্রতি ১০০ গ্রাম)
পুষ্টি উপাদান | পরিমাণ | দৈনিক চাহিদা মূল্য (%DV)* |
---|---|---|
ক্যালোরি | ২৪৫ কিলোক্যালোরি | ১২% |
মোট চর্বি | 0.3 গ্রাম | 0.5% |
সোডিয়াম | ৩৭ মিলিগ্রাম | ২% |
পটাসিয়াম | 0 মিলিগ্রাম | 0% |
মোট কার্বোহাইড্রেট | ৪৯.৯ গ্রাম | ১৭% |
ডায়েটারি ফাইবার | ৩২.৩ গ্রাম | ১২৯% |
চিনি | 0 গ্রাম | 0% |
প্রোটিন | 0 গ্রাম | 0% |
দৈনিক চাহিদা মূল্য (DV) ২,০০০ ক্যালোরি মানের একটি খাদ্যের উপর ভিত্তি করে নির্ধারিত হয়েছে।
দ্রষ্টব্য: এটি একটি সাধারণ ইঙ্গিত, মানগুলি পরিবর্তিত হতে পারে।
অশ্বগন্ধার এর উপকারিতা
এর মাধ্যমে আমরা অনেক শারীরিক ও মানসিক অসুস্থতা থেকে মুক্তি পেতে পারি।
চলুন জেনে আসা যাক এর উপকারিতা সমূহ
অনিদ্রা দূর করতে সাহায্য করে
অনেক আয়ুর্বেদিক বিশেষজ্ঞদের মতে অশ্বগন্ধার শিকড় ঘুমের গুণমান উন্নত করতে সাহায্য করে। বিশেষজ্ঞদের মতে, অশ্বগন্ধায় প্রাকৃতিকভাবে উপস্থিত ট্রাইথিলিন গ্লাইকোল নামক যৌগ রয়েছে যা অনিদ্রা দূর করতে সাহায্য করে।
আপনার যদি অনিদ্রার সমস্যা হয় তবে এই আয়ুর্বেদ ভেষজটি ব্যবহার করতে পারেন।
স্ট্রেস দূর করতে সাহায্য করে
রোজকার জীবনের উদ্বেগ, চিন্তা দূর করার জন্য় অনেকেই ওষুধ খান। কিন্তু স্ট্রেস কমাতে বাড়িতেই ভেষজ উপায়ে খান স্ট্রেস।
বিশেষজ্ঞদের মতে, অশ্বগন্ধায় অ্যাডাপ্টোজেন রয়েছে, যা শরীরকে মানসিক চাপ থেকে মোকাবিলা করতে সহায়তা কর
টেস্টোস্টেরন হরমোনের উৎপাদন বাড়ায়
বিশেষজ্ঞদের মতে, পুরুষদের টেস্টোস্টেরন হরমোনের উৎপাদন কমে যাওয়ার ফলে যৌন আকাঙ্ক্ষা কমে যায়। নিয়মিত এই ভেষজটি ডায়েটে রাখলে যৌন আসক্তিও বাড়ে। বিশেষজ্ঞদের মতে, অশ্বগন্ধার মধ্যে যৌন উদ্দীপক যৌগ থাকে।
যা যৌগ শরীরে নাইট্রিক অক্সাইডের উৎপাদন বাড়িয়ে তোলে এবং শরীরের বিভিন্ন অঙ্গে রক্ত সঞ্চালন বাড়ে। ফলে যৌনশক্তিও বৃদ্ধি পায়।
শরীরের প্রদাহ দূর করে
আয়ুর্বেদে অশ্বগন্ধার প্রদাহ-বিরোধী বৈশিষ্ট্যের জন্যও পরিচিত। এটি শরীরের গুরুতর প্রদাহের চিকিত্সা করতে সহায়তা করে।
গবেষণায় জানা গিয়েছে যে এই ভেষজটি ইমিউন কোষ তৈরি করতে পারে যা শরীরকে প্রদাহ-সৃষ্টিকারী সংক্রমণ থেকে রক্ষা করে এবং শরীরকে সুস্থ থাকতে সাহায্য করে।
সহনশীলতা বাড়ায়
অশ্বগন্ধা শারীরিক পারফরম্যান্সকে আরও উন্নত করার পাশাপাশি যৌন স্বাস্থ্যের উন্নতিতেও করাতে কাজ করে।
নিয়মিত অশ্বগন্ধা সেবনের ফলে ধৈর্য্যশীলতা, শারীরিক ক্রিয়াকলাপ ও সহনশীলতা প্রভৃতির উন্নতি ঘটে।
রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়
অশ্বগন্ধায় অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট উপাদান থাকার ফলে এটি শরীরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে অনেক সাহায্য করে।
থাইরয়েডের সমস্যা কমাতে
হাইপোথাইরয়েডের অর্থাৎ যাদের শরীরে থাইরয়েড হরমোনের পরিমান কম থাকে তাদের এই সমস্যা দূর করতে ব্যবহৃত হয় অশ্বগন্ধা। শরীরে থাইরক্সিন হরমোনের পরিমান বাড়ায় এই অশ্বগন্ধা।
চোখের সমস্যা কমাতে
প্রাচীনকালে চোখের স্বাস্থ্য ভালো করতে অশ্বগন্ধা ব্যবহার করা হত বলে জানা যায় ।
আর্থ্রাইটিস সারাতে
আর্থ্রাইটিস এর ব্যথার তীব্রতা কমাতে অশ্বগন্ধার গুঁড়ো খুবই উপযোগী। আয়ুর্বেদ শাস্ত্রে আর্থ্রাইটিস সারাতে অশ্বগন্ধা ব্যবহৃত হয়।
ক্যান্সার প্রতিরোধ করতে
অশ্বগন্ধা ক্যান্সারের প্রতিরোধক হিসেবে কার্যকর ফলাফল দেয়।আয়ুর্বেদ শাস্ত্রে মতে অশ্বগন্ধার পাতা ও মূলের নির্যাসে উপস্থিত ফাইটোকেমিক্যালস টিউমার কোষকে ধ্বংস করতে ও সেই কোষে রক্ত সরবারহ বন্ধ করে দেয় ।
ক্যান্সারের সময় কেমোথেরাপির মধ্যে দিয়ে যাদের যেতে হয়, তাদের জীবনের মানের উন্নতি ঘটাতে সাহায্য করে অশ্বগন্ধা।
ডায়াবেটিসের সমস্যা কমাতে
অশ্বগন্ধার মূল ও পাতার নির্যাস অ্যান্টি-ডায়াবেটিক উপাদান থাকে। এই অংশের কোষে যে ফ্ল্যাভোনয়েডস থাকে তা ডায়াবেটিসে আক্রান্ত মানুষদের শরীরে ইনসুলিনের পরিমাণ বাড়াতে সাহায্য করে।
এছাড়াও অশ্বগন্ধা ডায়াবেটিসে আক্রান্ত রোগীদের শরীরে লিপিডের পরিমান ঠিক রাখতে সাহায্য করে বলে জানা গেছে।
স্মৃতিশক্তি উন্নত করে
যাদের অ্যালজাইমারস রোগ আছে, তাদের ক্ষেত্রেও অবস্থার উন্নতিতে অশ্বগন্ধা কাজ করে।
পেশী মজবুত করে
অশ্বগন্ধা পেশী মজবুত করতে যে কার্যকরী ফলাফল দেয়। পেশিতে কোনো আঘাত পেলে সেটি তা সারাতে সাহায্য করে।
এছাড়াও ব্যায়াম করার ফলে পেশিতে যে চাপের সৃষ্টি হয় তা কমাতেও অশ্বগন্ধা ব্যবহৃত হয়।
ইনফেকশন থেকে বাঁচায় অশ্বগন্ধা
অশ্বগন্ধার নানা ধরণের ইনফেকশন থেকে আমাদের বাঁচাতে সাহায্য করে কারণ এর পাতা ও মূলে রয়েছে অ্যান্টি-ইনফ্লেমেটরি এর মত উপাদান।
খুশকি কমাতে
বেশিরভাগ খুশকি কমানোর শ্যাম্পুতে অশ্বগন্ধা থাকে কারণ অশ্বগন্ধার গুঁড়ো দিয়ে তৈরী তেল ও শ্যাম্পু খুশকি কমাতে অনবদ্য কাজ করে।
অকালে চুল পাকা আটকাতে
আয়ুর্বেদ শাস্ত্র অনুযায়ী অশ্বগন্ধা গাছের নির্যাস অকালে চুল পাকা আটকাতে খুবই উপকারী।
চুলকে মজবুত করতে
চুলকে ঝলমলে ও স্বাস্থ্যকর করে তুলতে আয়ুর্বেদ শাস্ত্রে অশ্বগন্ধাকে খুবই উপযোগী বলে মানা হয়।
বার্ধ্যকের ছাপ দূর করতে
আয়ুর্বেদ শাস্ত্রে মনে করা হয় অশ্বগন্ধা গাছের নির্যাস বার্ধ্যকের ছাপ পড়তে দেয় না।
ক্ষত সারাতে
অশ্বগন্ধার ভিতর অ্যান্টি-ইনফ্লেমেটরি উপাদান থাকার ফলে এটি শরীরের ক্ষত সারাতে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে।
কর্টিসল লেভেল কমাতে
মানব শরীরে অ্যাডরিনালিন গ্ল্যান্ডের কোনো সমস্যা থাকলে রক্তে কর্টিসলের পরিমান কম বেশি হয়, এই সমস্যা থেকে রক্ষা পেতে অশ্বগন্ধা ভালো সাহায্য করে।
অশ্বগন্ধার অপকারিতা
- যাঁদের শরীরে পিত্তের প্রভাব থাকে তাঁদের শরীর স্বভাবতই উষ্ণ থাকে, অশ্বগন্ধার উষ্ণ প্রভাবের দরুণ, ওইসব ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে এটির দীর্ঘস্থায়ী ব্যবহার ভাল হয় না। দীর্ঘদিন ধরে ব্যবহার করলে গ্যাস্ট্রিক আলসার, ডায়রিয়া, এবং বমিভাব দেখা যেতে পারে।
- নিজের খাদ্যাভ্যাসে অশ্বগন্ধা ব্যবহার করতে চাইলে রেজিস্ট্রিকৃত চিকিৎসকের পরামর্শ নিন। যে ওষুধ আপনি ইতিমধ্যেই গ্রহণ করেছেন তার প্রতিক্রিয়ার ওপর এটি প্রভাব ফেলতে পারে। যেমন, যিনি রক্তে শর্করা কমানোর ওষুধ নিয়ে থাকেন তিনি অশ্বগন্ধা ব্যবহার করলে রক্তে শর্করার মাত্রা বেশি নেমে যেতে পারে হাইপোগ্লাইসেমিয়া।
- গর্ভবতী মহিলাদের ক্ষেত্রে এটির ব্যবহার নিরাপদ বলে মনে করা হয় না, বহুসময় দেখা গিয়েছে, পশুপাখিদের বেশি মাত্রার ডোজ দেওয়ার ফলে গর্ভপাত অথবা নির্দিষ্ট সময়ের আগে প্রসব হয়ে গিয়েছে।
- অশ্বগন্ধা রক্ত পাতলা করে এবং এটি অ্যান্টিকোঅ্যাগুলেন্ট, কাজেই আপনার শরীরে যদি অস্ত্রোপচারের কথা থাকে বা আপনার শরীরে সাম্প্রতিককালে অস্ত্রোপচার হয়ে থাকে তাহলে এটি ব্যবহার করা উচিত নয়। যদি আপনি সক্ত পাতলা করার ওষুধ গ্রহণ করছেন তাহলে তার সঙ্গে এটি ব্যবহার করা উচিত নয় কারণ তাহলে রক্ত বেশি পাতলা হয়ে যেতে পারে যা আপনার স্বাস্থ্যের পক্ষে ভাল নয়।
- এটির মধ্যে সামান্য ঘুমের ওষুধের কার্যকারিতা থাকে বলে এটি খেলে ঘুম ঘুম ভাব আসতে পারে। কাজেই কোনও ঘুমের ওষুধের সঙ্গে এটি গ্রহণ করা উচিত নয়, কারণ তাতে অতিরিক্ত ঘুম হবে।
অশ্বগন্ধা কীভাবে খাবেন?
অশ্বগন্ধার খাওয়ার বেশ কয়েকটি নিয়ম রয়েছে এটি যখন তখন খেলেই যে উপকারিতা পাবেন তা কিন্তু নয় এটি খাওয়ার নিয়ম গুলো মেনে খেলেই উপকারিতা পাবেন।
- এক চামচ অশ্বগন্ধার গুঁড়ো ঈষদুষ্ণ জলে গুলে দশ মিনিট রেখে দিন। এর পর সেই পানীয় খেয়ে ফেলুন। বিশেষজ্ঞদের মতে, দিনে এক থেকে দুইবার এই পানীয় খেলে উপকার পাবেন।
- ঘুমানোর আগে গরম দুধে এক চামচ অশ্বগন্ধার গুঁড়ো মিশিয়েও খাওয়া যেতে পারে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।
- তবে অবশ্য অশ্বগন্ধার ট্যাবলেটও পাওয়া যায়। সেটিও খেতে পারেন।
অশ্বগন্ধা ব্যাবহার
নিদ্রাহীনতা, টিউমার, যক্ষা, অ্যাজমা বা হাঁপানি, লিউকোডার্মা, ব্রঙ্কাইটিস, ফাইব্রোমায়লজিয়া, অ্যাড্রিনাল ফেটিগ জাতীয় রোগের ক্ষেত্রে বরাবর অশ্বগন্ধার মূল ব্যবহার হয়ে এসেছে।
তবে শারীরিক এবং মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নতির জন্য, যা আয়ুর্বেদ শাস্ত্রে রসায়ন বলে অভিহিত হয়, এই ভেষজ উদ্ভিদটি মূলত সাধারণ টনিক বেশি ব্যবহার হয়।
কিছু গবেষকের মতে আপনার স্বাস্থ্যের উন্নতির জন্য অশ্বগন্ধা হচ্ছে অন্যতম পন্থা, কারণ এটি একটি পুষ্টিবর্ধক টনিক যা আপনার বাগান থেকেই উদ্ভূত হয়।
অশ্বগন্ধার সর্বাধিক ব্যবহার চায়ের গুঁড়োর মত পাউডার আকারে। দুধ, ঘি বা মধুর সঙ্গে মিশ্রিত করে এটি খাওয়া হয়।
বর্তমানে অশ্বগন্ধা টিংচার উদ্ভিদের নির্যাসের সঙ্গে অ্যালকোহলের মিশ্রণ এবং ক্যাপসুল বেশি জনপ্রিয় কারণ এগুলি গ্রহণ করা সহজ এবং এগুলি কাজও করে দ্রুত।