হার্ট অ্যাটাক হলে করণীয়

হার্ট অ্যাটাক, বা ‘মায়োকার্ডিয়াল ইনফার্কশন’, হৃৎপিণ্ডের পেশীতে রক্তপ্রবাহ ব্যাহত হওয়ার কারণে ঘটে। এটি একটি গুরুতর স্বাস্থ্যগত জরুরী অবস্থা যা তাৎক্ষণিক চিকিৎসার প্রয়োজন।

হার্ট অ্যাটাকের সম্মুখীন ব্যক্তিদের দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া এবং যথাযথ চিকিৎসা সহায়তা পাওয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।  এই নিবন্ধে, আমরা হার্ট অ্যাটাকের লক্ষণ, প্রাথমিক চিকিৎসা, এবং পরবর্তী যত্ন সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করব।

হার্ট অ্যাটাকের লক্ষণ

বুকে অস্বস্তি

• বুকের মাঝখানে অস্বস্তি, ব্যথা, চাপ, বা ভারী বোধ হওয়া।

• এই যন্ত্রণা কয়েক মিনিট স্থায়ী হতে পারে।

• কিছুক্ষেত্রে এটি হঠাৎ শুরু হয়, কিছু ক্ষেত্রে আবার ধীরে ধীরে তৈরি হয়।

• বিশ্রামের সময়ও বজায় থাকতে পারে।

অন্যান্য অংশে ব্যথা ছড়িয়ে পড়া

• ব্যথা বুক ছাড়িয়ে কাঁধ, ঘাড়, চোয়াল, বা হাতে ছড়িয়ে যেতে পারে।

শ্বাসকষ্ট

• হঠাৎ শ্বাসকষ্ট অথবা হাঁপানো ভাব, বিশেষ করে বুকে ব্যথার সাথে হলে তা সতর্কবার্তা।

মাথা ঘোরা বা অজ্ঞান হয়ে যাওয়া

• রক্তপ্রবাহ কমে যাওয়ার কারণে মাথা ঘোরা বা অজ্ঞান হয়ে যাওয়ার মতো লক্ষণ দেখা দিতে পারে।

বমি বমি ভাব বা বমি

• বমি বমি ভাব বা বমি করার ইচ্ছা হতে পারে।

বুকে অস্বস্তি

বুকে অস্বস্তি বলতে বুকের মাঝখানে অস্বস্তি, ব্যথা, চাপ, বা ভারী বোধ হওয়া বোঝায়। এই যন্ত্রণা কয়েক মিনিট স্থায়ী হতে পারে। কিছুক্ষেত্রে এটি হঠাৎ শুরু হয়, আবার কিছুক্ষেত্রে ধীরে ধীরে তৈরি হয়। এটি বিশ্রামের সময়ও বজায় থাকতে পারে।

এই অস্বস্তি বিভিন্ন রকম হতে পারে

• চাপ: বুকের উপরে ভারী কিছু রাখা আছে এমন অনুভূতি।

• ব্যথা: তীক্ষ্ণ, ছুরিকাঘাতের মতো, বা জ্বলন্ত ব্যথা।

• জ্বালা: বুকের ভেতরে জ্বলন্ত অনুভূতি।

• আঁটসাঁট ভাব: বুকের মাংসপেশি আঁটসাঁট বা শক্ত অনুভূতি।

• অস্বস্তি: বর্ণনা করা কঠিন, অস্পষ্ট অস্বস্তি।

ব্যথার তীব্রতাও বিভিন্ন হতে পারে

• হালকা: খুব সামান্য অস্বস্তি।

• মাঝারি: লক্ষণীয় অস্বস্তি, কিন্তু দৈনন্দিন কাজকর্মে বাধা সৃষ্টি করে না।

• গুরুতর: তীব্র ব্যথা, যা দৈনন্দিন কাজকর্মে বাধা সৃষ্টি করে এবং শ্বাসকষ্টের সাথে থাকতে পারে।

ব্যথা ছড়িয়ে পড়া

বুকে ব্যথা কেবল বুকে সীমাবদ্ধ থাকতে পারে না, বরং অন্যান্য অংশেও ছড়িয়ে পড়তে পারে, যেমন:

• কাঁধ: ব্যথা বুক থেকে কাঁধে ছড়িয়ে যেতে পারে, বিশেষ করে বাম কাঁধে।

• ঘাড়: ব্যথা বুক থেকে ঘাড়ে ছড়িয়ে যেতে পারে।

• চোয়াল: ব্যথা বুক থেকে চোয়ালে ছড়িয়ে যেতে পারে।

• হাত: ব্যথা বুক থেকে বাহুতে, বিশেষ করে বাম বাহুতে ছড়িয়ে যেতে পারে।

হার্ট অ্যাটাকের অন্যান্য লক্ষণ

অস্বাভাবিক ক্লান্তি

• হার্ট অ্যাটাকের কারণে হৃৎপিণ্ড শরীরে পর্যাপ্ত রক্ত ​​পাম্প করতে পারে না, যার ফলে অস্বাভাবিক ক্লান্তি দেখা দিতে পারে।

• এই ক্লান্তি হঠাৎ আসতে পারে এবং দৈনন্দিন কাজকর্ম করতে বাধা সৃষ্টি করতে পারে।

• ক্লান্তি শুধুমাত্র শারীরিক পরিশ্রমের সময়ই নয়, বিশ্রামের সময়ও অনুভূত হতে পারে।

অস্বস্তি ও দুশ্চিন্তা

• হার্ট অ্যাটাকের সময় বুকে ব্যথার সাথে অস্বস্তি ও দুশ্চিন্তা দেখা দিতে পারে।

• এই অস্বস্তি বুকে চাপ, ভারী বোধ, বা জ্বালাপোড়ার মতো হতে পারে।

• দুশ্চিন্তা তীব্র হতে পারে এবং শ্বাসকষ্টের সাথে থাকতে পারে।

ঘাম হওয়া

• হার্ট অ্যাটাকের সময় ঠান্ডা ঘাম হতে পারে।

• ঘাম হালকা থেকে তীব্র হতে পারে।

• ঘাম পুরো শরীরে বা শুধুমাত্র মুখ, ঘাড়, বা বুকে হতে পারে।

মনে রাখা জরুরি

• সবার হার্ট অ্যাটাকের লক্ষণগুলি এক হয় না। কিছু রোগীর ক্ষেত্রে হালকা উপসর্গ দেখা যায়, আবার কিছু রোগীর মারাত্মক উপসর্গ দেখা দেয়।

• মহিলাদের মধ্যে হার্ট অ্যাটাকের কিছু উপসর্গ পুরুষদের চেয়ে ভিন্ন হতে পারে।

হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকির কারণ

• উচ্চ রক্তচাপ I

• উচ্চ কোলেস্টেরল I

• ডায়াবেটিস I

• ধূমপান I

• স্থূলতা I

• অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস I

• শারীরিকভাবে নিষ্ক্রিয়তা I

• পারিবারিক ইতিহাস I

• মানসিক চাপ I

হার্ট অ্যাটাক হলে করণীয়

• দ্রুত জরুরি চিকিৎসা সহায়তা নিন।

• অ্যাসপিরিন গ্রহণ (যদি ডাক্তার নির্দেশ করে থাকেন) I

• বিশ্রাম নিন I

• নাইট্রোগ্লিসারিন গ্রহণ (যদি থাকে) I

• কাশি দিন I

হার্ট অ্যাটাকের পরবর্তী যত্ন

• ওষুধ সেবন I

• জীবনধারায় পরিবর্তন I

• কার্ডিয়াক রিহ্যাবিলিটেশন I

হার্ট অ্যাটাক একটি জরুরী অবস্থা। দ্রুত চিকিৎসা হার্ট অ্যাটাকের ক্ষতি কমাতে এবং জীবন বাঁচাতে পারে। হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি কমাতে এবং হৃৎপিণ্ড সুস্থ রাখার জন্য স্বাস্থ্যকর জীবনধারা বজায় রাখা জরুরি।

মনে রাখা জরুরি

• সবার হার্ট অ্যাটাকের লক্ষণগুলি এক হয় না। কিছু রোগীর ক্ষেত্রে হালকা উপসর্গ দেখা যায়, যেমন বুকে অস্পষ্ট অস্বস্তি, দুর্বলতা, বা শ্বাসকষ্ট। আবার কিছু রোগীর মারাত্মক উপসর্গ দেখা দেয়, যেমন তীব্র বুকে ব্যথা, শ্বাসকষ্ট, বা অজ্ঞান হয়ে যাওয়া।

• মহিলাদের মধ্যে হার্ট অ্যাটাকের কিছু উপসর্গ পুরুষদের চেয়ে ভিন্ন হতে পারে। মহিলাদের ক্ষেত্রে, বুকে ব্যথার পরিবর্তে, পেটে ব্যথা, ঘাড়ে ব্যথা, বা চোয়ালে ব্যথা হতে পারে।

কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়

• কোনো লিঙ্গের জন্য হলেও, হার্ট অ্যাটাকের যেকোনো লক্ষণ দেখা গেলে দ্রুত চিকিৎসা সহায়তা নেওয়া জরুরি। দ্রুত চিকিৎসা হার্ট অ্যাটাকের ক্ষতি কমাতে এবং জীবন বাঁচাতে পারে।

• হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি কমাতে স্বাস্থ্যকর জীবনধারা বজায় রাখা গুরুত্বপূর্ণ।

• নিয়মিত মেডিকেল চেক-আপ করুন এবং আপনার ডাক্তারের সাথে আপনার হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি নিয়ে আলোচনা করুন।

হার্ট অ্যাটাকের লক্ষণ দেখা দিলে করণীয়

হার্ট অ্যাটাকের লক্ষণগুলি দেখা দিলে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই পদক্ষেপগুলি জীবন রক্ষা করতে পারে।

দ্রুত জরুরি চিকিৎসা সহায়তা নিন

• অবিলম্বে অ্যাম্বুলেন্সে যোগাযোগ করে চিকিৎসা সহায়তা নিন।

• আপনি যদি একা থাকেন, চিৎকার করে প্রতিবেশীকে ডেকে সাহায্য চান।

অ্যাসপিরিন গ্রহণ

• আপনার ডাক্তার দ্বারা নির্দেশিত হলে, 300 মিলিগ্রাম অ্যাসপিরিন চিবিয়ে খান। অ্যাসপিরিন রক্ত ​​জমাট বাঁধতে বাধা দেয় এবং হার্ট অ্যাটাকের তীব্রতা কমাতে সাহায্য করতে পারে।

বিশ্রাম

• একটি আরামদায়ক অবস্থানে বসুন বা শুয়ে পড়ুন এবং বিশ্রাম নিন। এটি হৃৎপিণ্ডের ওপর চাপ কমাতে সাহায্য করবে।

নাইট্রোগ্লিসারিন গ্রহণ (যদি থাকে)

• আপনার যদি অ্যাঞ্জাইনা থাকে এবং আপনার ডাক্তার নাইট্রোগ্লিসারিন প্রেসক্রাইব করে থাকেন, তবে হার্ট অ্যাটাকের লক্ষণগুলি শুরু হওয়ার সাথে সাথে তা গ্রহণ করুন।

কাশি দিন

• অ্যাম্বুলেন্স আসার আগ পর্যন্ত শক্তিশালী কাশি দিতে থাকুন। এটি রক্তচাপ বজায় রাখতে এবং রক্ত সঞ্চালন উন্নত করতে সাহায্য করতে পারে।

অ্যাম্বুলেন্স না আসা পর্যন্ত করণীয়

• রোগীর কাছাকাছি থাকুন এবং তাদেরকে আশ্বস্ত করুন।

• রোগী যদি অজ্ঞান হয়ে যায়, তবে তাদের সিপিআর (CPR) শুরু করুন (যদি প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত হন)।

হাসপাতালে চিকিৎসা

হার্ট অ্যাটাকের জন্য চিকিৎসায় রোগীর লক্ষণ, মেডিকেল ইতিহাস, এবং ডায়াগনস্টিক পরীক্ষার ফলাফলের উপর নির্ভর করে। কিছু সাধারণ চিকিৎসা পদ্ধতি হল:

• ওষুধ: অ্যাসপিরিন, অ্যান্টি-প্লেটলেট ওষুধ, রক্ত ​​জমাট বাঁধা রোধ করার ঔষধ (anti-clotting medication), ব্যথানাশক, নাইট্রোগ্লিসারিন ইত্যাদি।

• সার্জারি এবং অন্যান্য পদ্ধতি: বন্ধ হয়ে যাওয়া ধমনী খোলার জন্য অ্যানজিওপ্লাস্টি এবং স্টেন্ট স্থাপন অথবা বাইপাস সার্জারীর প্রয়োজন হতে পারে।

• কারডিয়াক রিহ্যাবিলিটেশন: এটি একটি পরিকল্পিত কর্মসূচি (supervised program) যা রোগীকে সুস্থ জীবনধারায় ফিরে যেতে সাহায্য করে।

হার্ট অ্যাটাক থেকে  রক্ষা পাওয়ার উপায়

• নিয়মিত ব্যায়াম করা : সপ্তাহের বেশিরভাগ দিন কমপক্ষে 30 মিনিটের মাঝারি-তীব্রতার ব্যায়াম করার লক্ষ্য রাখুন।

• স্বাস্থ্যকর ওজন বজায় রাখা: অতিরিক্ত ওজন বা স্থূলতা হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি বাড়ায়।

• ধূমপান ত্যাগ: ধূমপান হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়ায়।

• অতিরিক্ত মদ্যপান না করা : অতিরিক্ত মদ্যপান হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি বাড়ায়।

• উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ: উচ্চ রক্তচাপ হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়ায়।

• কোলেস্টেরলের মাত্রা নিয়ন্ত্রণ: উচ্চ কোলেস্টেরল হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়ায়।

• ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ: ডায়াবেটিস হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়ায়।

• চাপ নিয়ন্ত্রণ: দীর্ঘস্থায়ী চাপ হৃদরোগের ঝুঁকি বৃদ্ধি করতে পারে।

• নিয়মিত চেক-আপ: নিয়মিত চেক-আপের মাধ্যমে হার্টের রোগের ঝুঁকি ফ্যাক্টরগুলি নিরীক্ষণ করা এবং প্রাথমিকভাবে কোন সমস্যা সনাক্ত করা যেতে পারে।

উপসংহার

হার্ট অ্যাটাক একটি গুরুতর স্বাস্থ্যগত জরুরি অবস্থা যা দ্রুত পদক্ষেপ এবং উপযুক্ত চিকিৎসার প্রয়োজন। হার্ট অ্যাটাকের লক্ষণগুলি সম্পর্কে সচেতন হওয়া এবং যদি লক্ষণ দেখা দেয় তবে দ্রুত চিকিৎসা সহায়তা নেওয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

একটি স্বাস্থ্যকর জীবনশৈলী বজায় রাখা এবং হৃৎপিণ্ডের স্বাস্থ্য রক্ষা করার জন্য চিকিৎসকের নির্দেশনা অনুসরণ করা হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি কমানোর মূল চাবিকাঠি।

গুরুত্বপূর্ণ পুনরাবৃত্তি

• আপনার হার্ট সম্পর্কে কোনো প্রশ্ন বা উদ্বেগ থাকলে অবিলম্বে আপনার ডাক্তারের সাথে পরামর্শ করুন।

• প্রাথমিক লক্ষণ দেখা দিলে দেরি না করে চিকিৎসা সহায়তা নিন।

• দ্রুত চিকিৎসা শুরু হওয়ার ফলে রোগ ক্রমবর্ধমান হওয়াকে রোধ করে দীর্ঘ ও সুস্থ জীবন নিশ্চিত করা সম্ভব।

স্বাস্থ্যকর জীবনশৈলী গড়তে এখন থেকেই শুরু করুন! আপনার হার্ট সারাজীবন ভালোভাবে কাজ করবে।

আমাদের সবারই একটি সুস্থ হৃদয় কামনা করি।

অস্বীকৃতি: এই নিবন্ধটি শুধুমাত্র তথ্যের উদ্দেশ্যে তৈরি করা হয়েছে এবং এটি পেশাদার চিকিৎসা পরামর্শের বিকল্প হিসেবে গণ্য করা উচিত নয়। সবসময় আপনার রক্তনালী বা যেকোনো স্বাস্থ্য সংক্রান্ত উদ্বেগের জন্য একজন যোগ্য চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।