দারচিনির উপকারিতা, পার্শপ্রতিক্রিয়া এবং ব্যবহারের নিয়ম
দারুচিনি অত্যন্ত সুস্বাদু মশলা। এটি হাজার বছরেরও বেশি সময় ধরে বিশ্বব্যাপী পরিচিত এর ঔষধি গুণাবলির জন্য। সাধারণত এটি একটি গাছের বাকল। যা অনেক রোগ নিরাময়ের ক্ষমতা রাখে।
দারুচিনির বাকল গাছের ছালের চেয়ে পাতলা, হলুদ এবং বেশি সুগন্ধযুক্ত। এটি রঙে নরম এবং মসৃণ। দারুচিনি পাতা ঘষলে এটি থেকে একটি তীব্র গন্ধ বের হয়। দারুচিনি অনেক রোগ নিরাময়ে ব্যবহৃত হয়।
দারুচিনির পুষ্টিগুণ
এটি পুষ্টিকর এবং প্রচুর ভিটামিনে পূর্ণ। প্রতি ১০০ গ্রামে দারুচিনিতে পানি ১০.৫৮ গ্রাম, এনার্জি ২৪৭ কিলোক্যালরি, প্রোটিন ৩.৯৯ গ্রাম, ফ্যাট১.২৪ গ্রাম, কার্বোহাইড্রেট ৮০.৫৯ গ্রাম এবং শর্করা ২১৭ গ্রাম থাকে।
দারুচিনির উপকারিতা
এই মসলার বিশেষ গুণ হল এটি শুধু রান্নাঘরেই ব্যবহৃত হয় না, দারুচিনি অনেক ধরনের ওষুধ ও রোগের চিকিৎসায়ও উপকারী। দারুচিনি বহু বছর ধরে আয়ুর্বেদিক এবং ঐতিহ্যবাহী চীনা ওষুধেও ব্যবহৃত হয়ে আসছে।
আজ জেনে নিন দারুচিনির স্বাস্থ্য উপকারিতা সম্পর্কে—
ঔষুধি গুণাবলি
প্রাচীন মিসরের ইতিহাসে দারুচিনি ওষুধ হিসেবে ব্যবহার হয়েছে। আর সে সময় এটি এতই বিরল ও মূল্যবান ছিল যে, রাজাদের জন্য উপযুক্ত উপহার হিসেবে বিবেচনা করা হতো একে।
বিজ্ঞানীরা এর অনেকে ঔষধি গুণাবলি খুঁজে পেয়েছে। তার মধ্যে অন্যতম একটি হচ্ছে বিপাকের ওপরে দারুচিনির প্রভাব। তবে এটি ছাড়াও আরও অনেক গুণ রয়েছে।
অ্যান্টিঅক্সিডেন্টে পরিপূর্ণ
দারুচিনি একটি শক্তিশালী অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট হিসেবে কাজ করে। আর অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট আপনার শরীরকে ফ্রি র্যাডিকেল দ্বারা সৃষ্ট অক্সিডেটিভ ক্ষতি থেকে রক্ষা করে। তাই দারুচিনি স্বাস্থ্যের জন্য অনকে উপকারী।
অ্যান্টি ইনফ্লেমেটরি
দারুচিনিতে অবিশ্বাস্যভাবে অ্যান্টি ইনফ্লেমেটরি উপাদান রয়েছে। গবেষণায় দেখা যায় যে, এই মসলা এবং এর অ্যান্টিঅক্সিডেন্টগুলোর শক্তিশালী অ্যান্টি-ইনফ্ল্যামেটরি বৈশিষ্ট্য রয়েছে।
আর এ কারণে এটি আপনার শরীরকে সংক্রমণের সঙ্গে লড়াই করতে এবং টিস্যুর ক্ষতি মেরামত করতে সহায়তা করতে অনেক কার্যকরী।
হৃদরোগের ঝুঁকি কমাতে পারে
হৃদরোগের ঝুঁকি কমাতেও অনেক উপকারী এই মসলাটি। এটি মোট কোলেস্টেরল থেকে খারাপ এলডিএল কোলেস্টেরল ও ট্রাইগ্লিসারাইডের মাত্রা কমায় এবং ভালো এইচডিএল কোলেস্টেরলকে স্থিতিশীল রাখে।
এ ছাড়া প্রাণী গবেষণায় দেখা গেছে যে, দারুচিনি রক্তচাপ কমাতেও অনেক উপকারী।
রক্তে শর্করার মাত্রা কমায়
দারুচিনি তার রক্ত-শর্করা-হ্রাসকারী বৈশিষ্ট্যের জন্য সুপরিচিত। বিভিন্ন মানব গবেষণায় দেখা গেছে যে,
দারুচিনির অ্যান্টি-ডায়াবেটিক প্রভাব রয়েছে এবং এটি রক্তে শর্করার মাত্রা ১০ থেকে ২৯৮ শতাংশ পর্যন্ত কমিয়ে দিতে পারে। আর এর উপকার পেতে আপনি চায়ের সঙ্গেও দারুচিনি খেতে পারেন।
নিউরোডিজেনারেটিভ রোগে উপকারী
মস্তিষ্কের কোষগুলোর গঠন বা কার্যকারিতার প্রগতিশীল ক্ষতি থেকে নিউরোডিজেনারেটিভ রোগ হয়ে থাকে। আর এ ধরনের রোগের সবচেয়ে সাধারণ দুটি প্রকার হচ্ছে আল্জ্হেইমার ও পারকিনসন।
পেটের সমস্যাগুলি উপশম করে
বেশির ভাগ পেটের সমস্যাগুলি নিয়ন্ত্রণ করতে দারুচিনি আপনাকে সাহায্য করে। পেট ফাঁপা, কোষ্ঠবদ্ধতা, এবং বমি বমি ভাব উপশম করার জন্য এটা ব্যবহৃত হয়। দারুচিনি পাকস্থলীর আলসার প্রতিরোধ করতে এবং ক্ষুধা বৃদ্ধি করতেও সহায়ক।
ডায়াবেটিস-প্রতিরোধী
দারুচিনি সক্রিয় যৌগগুলিতে সমৃদ্ধ, যেগুলি ইনসুলিন সংবেদনশীলতা বাড়ায় এবং এভাবে রক্তের শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখে বলে বিভিন্ন ক্লিনিক্যাল গবেষণায় ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে।
ওজন কমানো উন্নত করে
এটা বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণিত হয়েছে যে দারুচিনিতে উপস্থিত সিনাম্যাল্ডিহাইড শরীরে চর্বি দহন করা উন্নত করে ওজন কমানোয় সাহায্য করে। দারুচিনি ক্ষুধার জ্বালা এবং পানভোজনও কমায়।
আর এ ধরনের রোগে উপকারী হিসেবে কাজ করতে পারে দারুচিনি। পারকিনসন্স রোগে আক্রান্ত ইঁদুরের ওপর করা একটি গবেষণায় দেখা যায় যে, দারুচিনি নিউরন রক্ষা করতে সাহায্য করে এবং নিউরোট্রান্সমিটারের মাত্রা স্বাভাবিক করে।
দারুচিনির পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া
উপকারিতার সাথে এর ছোটখাটো কিছু পার্শ্ব প্রতিক্রিয়াও রয়েছে চলুন জেনে আসা যাক এর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া গুলো।
দারুচিনির একটা স্বাভাবিক উষ্ণতাদায়ক প্রভাব রয়েছে সেজন্য প্রয়োজনীয় মাত্রার চেয়ে দারুচিনি বেশি গ্রহণ করা পাকস্থলীতে জ্বলুনি সৃষ্টি করতে পারে।
দারুচিনির কুমারিন নামে একটা উপাদান আছে যা, বেশি মাত্রায় নিলে, লিভারের ক্ষতি করতে পারে।
কিছু ব্যক্তি জন্মগতভাবে দারুচিনির প্রতি প্রতিক্রিয়াপ্রবণ অ্যালার্জিক । সমীক্ষাগুলি দেখায় যে সিনাম্যাল্ডিহাইড হচ্ছে দারুচিনিতে বিদ্যমান অ্যালার্জেন অ্যালার্জি কারক শক্তি এবং এটা শারীরিকভাবে প্রবণ ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে মুখে ক্ষত সৃষ্টি করে বলে বিদিত।
দারুচিনি হচ্ছে একটা স্বাভাবিক হাইপোগ্লাইসেমিক শক্তি রক্ত শর্করা কমানো , সুতরাং যদি আপনার ডায়াবেটিস থাকে এবং আপনি ডায়াবেটিস-প্রতিরোধী ঔষধ নেন, আপনার খাদ্যতালিকায় দারুচিনি নেবার আগে আপনার ডাক্তারকে জিজ্ঞাসা করা বাঞ্ছনীয়।
দারুচিনি একটা রক্ত তরলকারী, সেজন্য যদি আপনি কোনও অস্ত্রোপচার করাতে যাচ্ছেন অথবা সম্প্রতি কোনও অস্ত্রোপচার করিয়েছেন, সেক্ষেত্রে কিছুদিনের জন্য দারুচিনি ব্যবহার না করা বাঞ্ছনীয়।
অমিশ্রিত দারুচিনি তেল হল একটা পরিচিত ত্বক জ্বলনকারী। সেজন্য সমস্ত শরীরে এটা লাগাবার আগে আপনাকে একটা প্যাচ টেস্ট করাতে পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে।
দারুচিনি খাওয়ার নিয়ম
দারুচিনি সাধারণত গরম মশলা হিসেবে রান্নায় ব্যবহার হয়ে থাকে। তবে দারুচিনি গুঁড়ো করে সেটা বিভিন্ন খাবারে মিশিয়ে খাওয়া যায় কিংবা চায়ের সঙ্গেও দারুচিনি মিশিয়ে খাওয়া যায়। এতে দারুন উপকার রয়েছে।
দারুচিনির প্রকারভেদ
দারুচিনির বেশ কিছু সংখ্যক বৈচিত্র্য রয়েছে কিন্তু দুটো সর্বাধিক পরিচিত ধরণ হল
সিলোন দারুচিনিঃ আসল দারুচিনি হিসাবেও পরিচিত। এটা শ্রীলঙ্কায় প্রচুর পরিমাণে চাষ করা হয় এবং অত্যন্ত মূল্যবান। এটার একটা মিষ্টি স্বাদ এবং মৃদু সুগন্ধ আছে। সিলোন দারুচিনি কাগজের পাতলা পরতে পরস্পরের সাথে ডগায় মোড়া একটা ফাঁপা নল গঠন করে এবং অনেক হালকা রঙের দেখতে হয়।
ক্যাসিয়া দারুচিনিঃ এর উৎসমূলের জন্য চীনা দারুচিনি হিসাবেও পরিচিত। এটা সর্বাধিক প্রচলিতভাবে ব্যবহৃত দারুচিনির ধরণ। ক্যাসিয়া দারুচিনির রং গাঢ় বাদামী এবং একটা তীব্র সুগন্ধ এবং মশলাদার স্বাদ আছে।
এই ধরণের দারুচিনির কাঠিগুলি একদিক অথবা উভয়দিক থেকে মাঝখানে একটা একক পুরু পাতের রোলিং গঠন করে। সিলোন দারুচিনির চেয়ে এতে কুমারিন উপাদান অনেক বেশি পরিমাণ থেকে এবং এজন্য লিভারের পক্ষে উচ্চতর শোষণে বিষাক্ত হয়।
দারুচিনি প্রতিদিন খেলে কি হয়
রক্তে বাড়তি শর্করার মাত্রা কমানোর জন্য দারুচিনি খুবই কার্যকর। সম্প্রতি দেখা গেছে যে, ৪০ দিন ধরে প্রতিদিন ৬ গ্রাম দারুচিনি খেলে রক্তে শর্করার মাত্রা অনেক কম থাকে। রক্তে কোলেস্টেরলের মাত্রা কমানোর ক্ষেত্রেও দারুচিনি অত্যন্ত কার্যকর ভূমিকা পালন করে।
দারুচিনি এর ব্যবহার
দারুচিনি চুল পড়া কমাতে এবং টাক পড়া প্রতিরোধে সহায়তা করে।
চুলে দারুচিনি ব্যবহার পদ্ধতি
চুলের বৃদ্ধিকে প্রভাবিত করতে দারুচিনি দুভাবে ব্যবহার করা যায়।
- দুই টেবিল-চামচ তাজা গুঁড়া করা দারুচিনি, এক চামচ মধু ও সামান্য নারিকেল তেল একটা পাত্রে মিশিয়ে ঘন পেস্ট করে নিতে হবে।মাস্কটি চুলে মেখে ২০ মিনিট অপেক্ষা করে ভালো মতো মালিশ করে নিতে হবে। এরপর চুল ধুয়ে ফেলতে হবে। নিয়মিত ব্যবহারে চুল দ্রুত বৃদ্ধি পারে।
- একটা ডিম, নারিকেল তেল এবং সদ্য গুঁড়া করা দারুচিনি মিশিয়ে ঘন পেস্ট তৈরি করে নিতে হবে।প্যাকটি মাথার ত্বক ও চুলে মেখে ৩০ মিনিট অপেক্ষা করে ধুয়ে ফেলতে হবে। চুল দ্রুত বাড়াতে ও ঘন রাখতে এই প্যাক উপকারী।