মসুর ডালের উপকারিতা, অপকারিতা এবং খাবার নিয়ম
মসুর ডাল তার স্বাদ এবং বহুমুখীতার জন্য একটি জনপ্রিয় খাদ্যোপাদান। এটি কেবল সুস্বাদুই নয়, বরং এর অনেক পুষ্টিগুণও রয়েছে।
মসুর ডাল প্রোটিন, ফাইবার, ভিটামিন এবং মিনারেলের একটি চমৎকার উৎস।
আসুন মসুর ডালের সম্ভাব্য উপকারিতা, অপকারিতা এবং এটি আমাদের খাদ্যতালিকায় কীভাবে অন্তর্ভুক্ত করা যায়, সেই বিষয়গুলি সম্পর্কে বিস্তারিত জেনে নেওয়া যাক।
১০০ গ্রাম শুকনা মসুর ডালের পুষ্টিগত মূল্য
পুষ্টি উপাদান | পরিমাণ | দৈনিক চাহিদার শতাংশ(%) |
ক্যালরি | ৩৫০ ক্যালরি | ১৭% |
কার্বোহাইড্রেট | ৬০ গ্রাম | ২০% |
এর মধ্যে ফাইবার | ৩১ গ্রাম | ১২০% |
প্রোটিন | ২৬ গ্রাম | ৫০% |
ভিটামিন বি৯ (ফলেট) | ৪৭৯ মাইক্রোগ্রাম | ১২০% |
আয়রন | ৯ মিলিগ্রাম | ১০০% (পুরুষ) / ৫০% (মহিলা) |
ম্যাঙ্গানিজ | ২ মিলিগ্রাম | ৮০-১০০% |
থায়ামিন (ভিটামিন বি১) | ০.৫ মিলিগ্রাম | ৪০% |
ফসফরাস | ৩৬০ মিলিগ্রাম | ৩৫% |
জিঙ্ক | ৩ মিলিগ্রাম | ৩০% |
পটাশিয়াম | ৬৭৫ মিলিগ্রাম | ১৫% |
বিস্তারিত ব্যাখ্যা
- ক্যালরি: ১০০ গ্রাম মসুর ডালে প্রায় ৩৫০ ক্যালরি থাকে, যা আপনার দৈনিক প্রয়োজনীয় ক্যালরির ১৭%।
- কার্বোহাইড্রেট ১০০ গ্রাম মসুর ডাল থেকে প্রায় ৬০ গ্রাম কার্বোহাইড্রেট পাওয়া যায়, যা আপনার দৈনিক প্রয়োজনের ২০%।
- ফাইবার: ১০০ গ্রাম মসুর ডাল প্রায় ৩১ গ্রাম ফাইবার সরবরাহ করে, যা আপনার দৈনিক প্রয়োজনের একটি তাৎপর্যপূর্ণ অংশ। অর্থা, ফাইবারের দিকথেকে মসুর ডাল দারুণ সমৃদ্ধ একটা খাবার।
- প্রোটিন: মসুর ডাল উচ্চ প্রোটিনের উৎস। প্রতি ১০০ গ্রামে আপনি প্রায় ২৬ গ্রাম প্রোটিন পাবেন, যা আপনার দৈনিক চাহিদার ৫০% পর্যন্ত পূরণ করতে সক্ষম।
- ভিটামিন বি৯ (ফলেট): মসুর ডাল ফলেটের একটি সমৃদ্ধ উৎস। ১০০ গ্রাম থেকেই প্রাপ্তবয়স্কদের প্রয়োজনীয় ফলেটের ১২০% পর্যন্ত থাকতে পারে। ফলেট মূলত স্বাস্থ্যকর কোষ বৃদ্ধি এবং গর্ভাবস্থায় শিশুর সঠিক বিকাশে গুরুত্বপূর্ন ভূমিকা পালন করে।
- আয়রন: মসুর ডাল আপনার দৈনিক আয়রনের চাহিদা পূরণে উপকারী। প্রয়োজনীয় দৈনিক আয়রনের একটি তাৎপর্যপূর্ণ অংশমাত্র ১০০ গ্রাম মসুর ডাল দিতে সক্ষম। আয়রন দেহের রক্তকণিকা তৈরি করে ও সারা শরীরে অক্সিজেন সরবরাহ করে।
মসুর ডালের উপকারিতা
প্রোটিন এবং ফাইবারের উৎস
- শর্করা হ্রাস, পেশী বৃদ্ধি: মসুর ডালে ধীর-হজমকারী কার্বোহাইড্রেট থাকে যা রক্তে শর্করার মাত্রা স্থিতিশীল রাখতে সাহায্য করে। ডালের প্রোটিন আপনার শরীরকে পেশী তৈরি এবং মেরামত করতে সহায়তা করে। এই দুটি উপাদানের সমন্বয় ওজন নিয়ন্ত্রণ, শক্তি বাড়ানো এবং ক্ষুধা কমাতে সাহায্য করে।
- মাংসের স্বাস্থ্যকর বিকল্প: যারা লাল মাংস কম খান বা সম্পূর্ণ নিরামিষভোজী তারা মসুর ডাল থেকে প্রয়োজনীয় প্রোটিন, আয়রন এবং অন্যান্য অপরিহার্য পুষ্টি পেতে পারেন।
হজমে সহায়ক
- প্রিবায়োটিকস: মসুর ডালের ফাইবার শুধু হজমই নয়, বরং ‘ভালো’ অন্ত্র ব্যাকটেরিয়াকেও বাড়িয়ে তুলতে সഹায়তা করে। এই প্রিবায়োটিক্সগুলি অন্ত্রের স্বাস্থ্যের একটি দিক যার ফলে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা এবং পরিপাক সিস্টেম সুচারুভাবে কাজ করে।
- পরিপাক নালীর প্রদাহ হ্রাস: মসুর ডালের বিশেষ ফাইবারসমূহ পরিপাক নালীর প্রদাহ কমাতে সাহায্য করতে পারে, যার ফলে ফোলাভাব, অম্লতা, ডায়রিয়া এবং আইবিএস এর মতো অবস্থার উপশম হতে পারে।
হৃদরোগের ঝুঁকি হ্রাস করে
- কোলেস্টেরল নিয়ন্ত্রণ: মসুর ডালে দ্রবণীয় ফাইবার রয়েছে যা ‘খারাপ’ এলডিএল কোলেস্টেরল মাত্রা কমাতে পারে। এছাড়া এর পটাশিয়াম রক্তচাপকে নিয়ন্ত্রণে রাখে যা স্ট্রোক সহ হার্টের সমস্যার ঝুঁকি কমাতে অত্যন্ত জরুরি।
- প্রদাহ বিরোধী বৈশিষ্ট্য: মসুর ডালে থাকা বিভিন্ন পলিফেনল যৌগ প্রদাহ কমাতে কার্যকর যা রক্তনালীর উপর সৃষ্ট চাপ কমাতে এবং ভাস্কুলার স্বাস্থ্য ভালো রাখতে সহায়তা করে।
রক্তে শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রণ
- নিম্ন গ্লাইসেমিক সূচক (GI): মসুর ডালের গ্লাইসেমিক ইন্ডেক্স কম, অর্থাৎ এটি আস্তে আস্তে শোষিত হয়। যার ফলে রক্তে শর্করার হঠাৎ বৃদ্ধি ঘটেনা, বরং দীর্ঘক্ষণ পর্যন্ত স্থিতিশীল থাকে। এটি ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ করতে সাহায্য করে এবং টাইপ-২ ডায়াবেটিসের ঝুঁকি হ্রাস করতে পারে।
অতিরিক্ত কয়েকটি অনুসঙ্গ
- অ্যান্টিঅক্সিডেন্টস: মসুর ডাল হল অ্যান্টিঅক্সিডেন্টসমৃদ্ধ। অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট ক্যান্সার, হৃদরোগ এবং বয়সজনিত অবক্ষয় রোধের মত দীর্ঘস্থায়ী রোগের বিরুদ্ধে আপনার শরীরকে রক্ষা করে।
- ভিটামিন ও খনিজসমৃদ্ধ: মসুর ডাল বি-ভিটামিন, আয়রন, জিঙ্ক, ম্যাঙ্গানিজ এবং ম্যাগনেসিয়ামসহ নানারকম ভিটামিন ও খনিজসমৃদ্ধ যা বিভিন্ন শারীরবৃত্তীয় কার্যকলাপে অপরিহার্য।
নিশ্চিত হন আপনি সঠিকভাবে মসুর ডাল রান্না করছেন
- ভিজিয়ে নিন: হজমের সমস্যা এড়াতে, মসুর ডাল রান্নার আগে কয়েক ঘন্টা ভিজিয়ে রাখুন।
- ভালোভাবে ধুয়ে নিন: রান্না করার আগে ডালটি ভালোভাবে ধুয়ে ফেলুন।
মসুর ডাল আপনার খাদ্যতালিকায় অন্তর্ভুক্ত করার একটি সহজ, বহুমুখী, সুস্বাদু এবং অর্থ সাশ্রয়ী উপায়। এটি আপনার সামগ্রিক স্বাস্থ্যের উন্নতি করতে এবং অনেক দীর্ঘস্থায়ী রোগের ঝুঁকি কমাতে সাহায্য করতে পারে।
মসুর ডালের অপকারিতা
- পেটের সমস্যা: যাদের হজমে সমস্যা বা আইবিএস (IBS) এর মত সমস্যা রয়েছে, তাদের মধ্যে অতিরিক্ত মসুরের ডাল খেলে গ্যাস, ফোলাভাব অথবা ডায়রিয়ার মত উপেটের সমস্যা হতে পারে।
- কিডনির সমস্যা: মসুর ডাল অক্সালেটে সমৃদ্ধ, যা কিডনির সমস্যা বা কিডনিতে পাাথর হওয়ার ঝুঁকি বাড়িয়ে তুলতে পারে, যদিকিডনির সমস্যা থেকে থাকে তাহলে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে ডাল সেবন করতে হবেে।
- পুষ্টি উপ্রতিরোধ: মসুর ডাল ফাইটেট এবং লেক্টিনের মতো যৌগসমূহ ধারণ করে,যা আপনার শরীরের আয়রন,জিঙ্ক,ক্যালসিয়ামএবং অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ পুষ্টি শোষণে বাধা দেয়। দীর্ঘমেয়াদি অপুষ্টির সমস্যা এড়াতে ডাল রান্নার আগে ভিজিয়ে নিলে এর প্রভাব কিছুটা কমে।
মসুর ডাল খাবার নিয়ম
- রান্নার পদ্ধতি: মসুর ডাল রান্নার আগে কয়েক ঘন্টা ভিজিয়ে এবং ধুয়ে নিন। এটি পেটে অস্বস্থি বা গ্যাসের ঝুঁকি কমিয়ে দেবে।
- পরিমাণ এবং ঘনঘন খাওয়া: মসুর ডাল পরিমিত পরিমাণে খাওয়া উচিৎ।এক সপ্তাহে দুই তিন দিনের বেশি নয়,এবং পরিমাণও একবাটি করে কম রাখা ভালো।
- অন্যান্য খাবারের সাথে মিশিয়ে: মসুর ডাল শুধু ডাল হিসেবো নয়; বিভিন্ন সবজি, সালাদ, স্যুপ অথবা তরকারির সাথে মিশিয়েও খাওয়া যেতে পারে।
উপসংহার
মসুর ডাল পুষ্টিকর এবং উপকারী খাবার হলেও এটি নিয়ন্ত্রিত পরিমাণে খাওয়া উচিৎ। কিডনির সমস্যা বা হজমে প্রবলেম থাকলে একজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।
অস্বীকৃতি: এই নিবন্ধে প্রদত্ত তথ্য শুধুমাত্র তথ্য প্রদানের উদ্দেশ্য এবং এটি চিকিৎসার পরামর্শের বিকল্প হিসেবে গণ্য করা উচিত নয়। স্বাস্হ্য সমপরকিত সিদ্ধান্ত নেওয়ার পূর্বে সর্বদা একজন যোগ্যতাসম্পন্ন চিকিৎসকেরসাথে পরামর্শ করুন।