মুলা খাবার উপকারিতা, অপকারিতা এবং সাবধানতা
বছরের অন্য সময়ের থেকে শীতকালে অনেক বেশি রকমের ফল ও সবজি পাওয়া যায়। সেরকমই একটা সবজি হলো মুলা। বছরের অন্য সময় এটি পাওয়া গেলেও শীতকালেই এই সবজি বেশি পরিমাণে খাওয়া হয়। মুলা দিয়ে বিভিন্ন তরকারি তো হয়ই একই সঙ্গে কাঁচাও খাওয়া যায়।
সারাবছরই কম-বেশি এই সবজি পাওয়া যায়। তবে সাধারণ সবজি মনে করে এটিকে অনেকেই পছন্দ করেন না। আবার অনেকে এতটাই পছন্দ করেন। কেউ কেউ সালাদেও কাঁচা মুলা ব্যবহার করেন। তবে এই সবজির রয়েছে অসাধারণ গুণ। এর উপকারিতা জানলে অবাক হবেন আপনিও।
মুলার পুষ্টি উপাদান
মূলায় বিভিন্ন পুষ্টি উপাদান থাকলেও, সুনির্দিষ্ট টেবিল তৈরি করা যেখানে মূলা আমাদের দৈনিক চাহিদা পূরণ করে সেটা বেশ জটিল। কারণ:
১. খাওয়ার অংশ:
- গাছের পুরো অংশ বনাম শুধু মূল: মূলার পাতায় গাছের মূলের তুলনায় ভিন্ন ধরনের পুষ্টির উপাদান থাকে।
- কাঁচা বনাম রান্না করা: রান্না করার প্রক্রিয়ায় পুষ্টি উপাদানের মাত্রা বিভিন্ন হতে পারে।
২. পরিবর্তনশীল দৈনিক চাহিদা: একজন ব্যক্তির দৈনিক পুষ্টির প্রয়োজনীয়তা তাদের বয়স, লিঙ্গ, এবং কার্যকলাপের স্তর ইত্যাদির উপর নির্ভর করে।
আনুমানিক পুষ্টি উপাদানের তালিকা (প্রতি ১ কাপ কাঁচা মূলা)
পুষ্টি উপাদান | পরিমাণ (আনুমানিক) | দৈনিক চাহিদা পূরণের শতাংশ (আনুমানিক)* |
---|---|---|
ক্যালোরি | ১৯ | ১% |
মোট কার্বোহাইড্রেট | ৪ গ্রাম | ১.৩৩% |
ফাইবার | ২ গ্রাম | ৮% |
প্রোটিন | ১ গ্রাম | ২% |
ভিটামিন C | ১৭ মিলিগ্রাম | ২২.৬৭% |
পটাশিয়াম | ২৭০ মিলিগ্রাম | ৫.৭৪% |
ফোলেট | ২৫ মাইক্রোগ্রাম | ৬.২৫% |
*একটি ২০০০ ক্যালোরির ডায়েট এবং গড় প্রাপ্তবয়স্কদের চাহিদার উপর ভিত্তি করে।
গুরুত্বপূর্ণ বিষয়সমূহ:
- ফাইবার ও ভিটামিন C এর ভালো উৎস : মূলা ফাইবার এবং ভিটামিন C এর মোটামুটি ভালো একটি উৎস।
- হাইড্রেশন: মূলায় প্রচুর পানি থাকে, যা শরীরকে আর্দ্র রাখতে সাহায্য করে।
- অন্যান্য খনিজের অল্প উপস্থিতি: মূলায় অল্প পরিমাণে পটাশিয়াম, ক্যালসিয়াম, এবং আয়রনের মত অন্যান্য খনিজ থাকে।
- বিভিন্ন খাবারের অংশ: মূলাকে সালাদ বা অন্যান্য খাবারের সঙ্গে খেলে আপনার সামগ্রিকভাবে পুষ্টির গ্রহণ বৃদ্ধি পায়।
মুলার উপকারিতা
আসলে এই সবজিটিতে উপস্থিত ফলেট, ফাইবার, রাইবোফ্লবেন, পটাশিয়াম, ভিটামিন বি৬, ম্যাগনেসিয়াম, ম্যাঙ্গানিজ এবং ক্যালসিয়াম দেহে প্রবেশ করার পর ভেতর এবং বাইরে থেকে শরীরকে এতটাই চাঙ্গা করে তোলে যে ক্ষতিকর জাবীণুদের মারে কোনও রোগে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা প্রায় থাকে না বললেই চলে। সেই সঙ্গে আরও অনেক শারীরিক উপকার পাওয়া যায়। যেমন ধরুন-
হার্টের স্বাস্থ্যের উন্নতি ঘটে
এই সবজিটিতে উপস্থিত ‘অ্যান্থোসায়ানিন’ নামক একটি উপাদান, শরীরে প্রবেশ করার পর এমন খেল দেখায় যে হার্টের ক্ষমতা বৃদ্ধি পেতে সময় লাগে না। ফলে কোনও ধরনের হার্টের রোগে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা প্রায় থাকে না বললেই চলে।
রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে চলে আসে
মুলায় রয়েছে প্রচুর মাত্রায় পটাশিয়াম, যা রক্তচাপকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে বিশেষ ভূমিকা পালন করে থাকে। তাই যাদের পরিবারে এই মারণ রোগের ইতিহাস রয়েছে, তারা রোজের ডায়েটে মুলাকে জায়গা করে দিতে ভুলবেন না যেন!
ত্বকের সৌন্দর্য বৃদ্ধি পায়
একাধিক স্টাডিতে এ কথা প্রমাণিত হয়ে গেছে যে নিয়মিত মুলার রস খাওয়া শুরু করলে শরীরে ভিটামিন সি, জিঙ্ক এবং ফসফরাসের মাত্রা এতটা বৃদ্ধি পায় যে এদের প্রভাবে ত্বকের স্বাস্থ্যের উন্নতি ঘটতে যেমন সময় লাগে না, তেমনি একাধিক ত্বকের রোগও ধারে কাছে ঘেঁষতে পারে না।
প্রসঙ্গত, মুলার পেস্ট মুখে লাগালেও কিন্তু সমান উপকার পাওয়া যায়।
ইমিউনিটির উন্নতি ঘটে
মুলা এবং তার পাতায় উপস্থিত আয়রন এবং ফসফরাস শরীরে প্রবেশ করার পর দেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে এতটাই শক্তিশালী করে তলে যে কোনও রোগই ধারে কাছে আসতে পারে না। সেই সঙ্গে শারীরিক ক্লান্তিও দূরে পালায়।
কনস্টিপেশনের মতো রোগের প্রকোপ কমায়
আপনি কি কোষ্ঠ্যকাঠিন্যের সমস্যায় ভুগছেন? তাহলে তো মুলার রস আপনার রোজের সঙ্গী হওয়া উচিত। আসলে এতে উপস্থিত বেশ কিছু কার্যকরি উপাদান হজম ক্ষমতার উন্নতি ঘটানোর পাশাপাশি বাইলের প্রবাহ যাতে ঠিক মতো হয় সে দিকেও খেয়াল রাখে।
ফলে স্বাভাবিকভাবেই কনস্টিপেশনের প্রকোপ কমতে শুরু করে। যা পাকস্থলীকে সুস্থ রাখে।
ভিটামিনের ঘাটতি দূর হয়
একাধিক স্টাডিতে দেখা গেছে, নিয়মিত মুলার পাতা খাওয়া শুরু করলে দেহের ভিতরে নানাবিধ ভিটামিনের পরিমাণ যেমন বাড়তে থাকে, তেমনি আয়রন, ক্যালসিয়াম এবং ফলিক অ্যাসিডের ঘাটতিও দূর হয়। ফলে স্বাভাবিকভাবেই ছোট-বড় কোনও রোগই ধারে কাছে ঘেঁষতে পারে না।
ক্ষতিকর টক্সিক উপাদানেরা বেরিয়ে যায়
ব্লাডার, কিডনি, প্রস্টেট এবং ডাইজেস্টিভ ট্র্যাকে জমে থাকা ক্ষতিকর উপাদানদের শরীর থেকে বের করে এই অঙ্গ-প্রত্যঙ্গগুলোর কর্মক্ষমতা বাড়াতে মুলার কোনও বিকল্প হয় না বললেই চলে।
শুধু তাই নয়, শরীরের কোণায় কোণায় জমে থাকা টক্সিক উপাদানদের ক্ষতি করার আগে তাদের কডনির মাধ্যমে শরীর থেকে বের করে দেওয়ার কাজটাও করে থাকে মুলার রস। প্রসঙ্গত, শরীর যত টক্সিক মুক্ত থাকবে, তত স্কিনের ঔজ্জ্বলতা বাড়বে। সেই সঙ্গে শরীর এবং মন চাঙ্গা এবং রোগ মুক্ত থাকবে।
শরীরে ভিতরে প্রদাহের মাত্রা কমে
প্রচুর মাত্রায় অ্যান্টি-ইনফ্লেমেটরি উপাদান থাকায় প্রতিদিন যদি মুলার রস খাওয়া যায়, তাহলে দেহের ভিতরে চোট-আঘাতের কারণে হওয়া জ্বালা-যন্ত্রণা কমতে শুরু করে।
সেই সঙ্গে ইউরিনারি ট্রাক্ট ইনফ্লেমেশন এবং কিডনির প্রদাহও কমে। প্রসঙ্গত, সম্প্রতি একটি গবেষণায় দেখা গেছে কিডনি স্টোনের আশঙ্কা কমাতেও মুলার রস নানাভাবে সাহায্য করে থাকে।
অ্যাস্থেমার চিকিৎসায় কাজে
শ্বাস কষ্ট, সেই সঙ্গে হাঁচি-কাশিতে একেবারে জর্জরিত হয়ে পরেছেন? ফিকার নট! আজ থেকেই মুলার রস খাওয়া শুরু করুন। দেখবেন কষ্ট কমে যাবে।
আসলে মুলার রস, লাং-এ জমতে থাকা মিউকাসের দেওয়ালকে ভেঙে দেয়। ফলে অল্প দিনেই অ্যাস্থেমার প্রকোপ কমতে শুরু করে। এখানেই শেষ নয়, বমি ভাব, গলার ব্যথা এবং মাথা ঘোরার মতো সমস্যা কমাতেও এই প্রকৃতিক উপাদানটি সাহায্য করে।
ক্যানসারের মতো মারণ রোগ দূরে পালায়
বর্তমান যা পরিস্থিতি তাতে শরীরকে এই মারণ রোগের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য প্রতিনিয়ত যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়া উচিত। আর এই কাজে আপনাকে ব্যাপকভাবে সাহায্য় করতে পারে মুলা।
আসলে মুলার রসে উপস্থিত অ্যান্থোসায়ানিন এবং ভিটামিন সি শরীরের ভিতরে ক্যানসার সেলেরে জন্ম এবং বৃদ্ধির আটকায়। বিশেষত কোলন, ইন্টেস্টিনাল,স্টমাক এবং কিডনি ক্যানসারে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা কমাতে এই পানীয়টি দারুনভাবে কাজে আসে।
মুলার অপকারিতা
মুলা খেলে কী কী বিপদ হতে পারে জেনে নিন-
হাইপোটেনশন
মুলা বেশি খেতে শুরু করলে, বা তা মাত্রারিক্ত হলে তাতে সমস্যা বাড়তে পারে। এতে রক্তচাপ নিম্নমুখী হতে পারে। ফলে যারা উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখার ওষুধ খাচ্ছেন,তারা মুলা কতটা খাবেন সেদিকে চিকিৎসকের সঙ্গে পরামর্শ করে খাওয়া উচিত। অতিরিক্ত মুলা খাওয়া রক্তচাপের ওপর প্রভাব ফেলে।
আয়রন
যদি আপনার শরীরে প্রচুর পরিমাণে আয়রন রয়েছে, আর আপনি তারপরও প্রচুর পরিমাণে মুলা খাচ্ছেন, তাহলে সাবধান হোন। কারণ শরীরে অনেক বেশি আয়রন থাকলে মুলা শরীরের পক্ষে ক্ষতিকারক হতে পাকে। এতে পেটব্যথা, বমি, মাথা ঘোরার সমস্যা হতে পারে। লিভারে সমস্যা হতে পারে। রক্তে সুগার কমে যাওয়ার সমস্যা হতে পারে।
থাইরয়েড
থাইরয়েড রোগীদের জন্য কাঁচা মুলা খাওয়া ঠিক নয়। থাইরয়েড গ্রন্থির সমস্যা অনেক সময় মুলার কারণে হয়ে থাকে। গয়ট্রোজেন নামক এক উপাদান মুলায় থাকার জেরে এই সমস্যা হয়ে থাকতে পারে অনেক সময়ে। তবে এই বিষয়ে চিকিৎসকের পরামর্শ নেয়া জরুরি।
ডিহাইড্রেশন
মুলা খাওয়ার ফলে বারবার মূত্রত্যাগের সমস্যা হয়। ফলে শরীর থেকে জল অনেকটাই বেরিয়ে যায়। ফলে মুলা খেলে জল ভালো পরিমাণে খেতে হবে। ফলে মুলা সীমিত পরিমাণে খাওয়া উচিত।
ব্লাড সুগার
ব্লাড সুগার লেভেল যাদের অনেকটাই কম থাকে, তাদের পক্ষে মুলা খাওয়া সঠিক নয়। এমনই মত বিশেষজ্ঞদের। এতে হাইপোগ্লাসিমিয়ার সমস্যা হতে পারে। এই তথ্য যাচাই করুন বিশেষজ্ঞের সঙ্গে পরামর্শ করার পর।
মুলা ও দই একসঙ্গে খাওয়া যাবে ?
যদিও পর্যাপ্ত বৈজ্ঞানিক প্রমাণ পাওয়া যায় না, কিন্তু মূলা ও দই একসঙ্গে খাওয়াকে ভালো খাবার হিসেবে বিবেচনা করা হয় না । সুতরাং, সাধারণত উভয়কে একসাথে গ্রহণ করা এড়াতে পরামর্শ দেওয়া হয়
মূলা খাওয়ার পর পায়খানা হয় কেন
এটি মূলা বা মুলিতে জলের উপাদানের কারণে । আপনি যখন পরোঠার জন্য কাঁচা মুলি/মুলা ব্যবহার করেন তখন মূলার প্রাকৃতিক জল রান্নার প্রক্রিয়ার সাথে ভালভাবে যায় না যা শেষ পর্যন্ত গ্যাস্টিক সমস্যাগুলির দিকে পরিচালিত করে।
মূলা দিয়ে কি খাওয়া যাবে না
শসা এবং মূলা একসঙ্গে খাওয়া উচিত নয় কারণ শসায় অ্যাসকরবেট থাকে, যা ভিটামিন সি শোষণ করতে কাজ করে? এ কারণে শসা ও মুলা একসঙ্গে খাওয়া উচিত নয়।