লিভার জন্ডিস হলে করণীয়
লিভার আমাদের দেহের একটি অত্যাবশ্যক অঙ্গ যা রক্ত পরিশোধন, বিপাক ক্রিয়া নিয়ন্ত্রণ, পুষ্টি উপাদান শোষণ, এবং ক্ষতিকারক পদার্থ অপসারণের মতো জটিল কার্যক্রমগুলো সম্পাদন করে।
জন্ডিস হলো এমন একটি চিকিৎসা পরিস্থিতি যখন রক্তে বিলিরুবিনের মাত্রা অত্যধিক বৃদ্ধি পেয়ে ত্বক, চোখের সাদা অংশ, এবং শ্লেষ্মা ঝিল্লি হলুদ বর্ণ ধারণ করে। লিভার জন্ডিস হলো এমন এক প্রকার জন্ডিস, যা মূলত লিভারের রোগ বা ব্যাধির কারণে সংঘটিত হয়।
লিভার জন্ডিসের কারণসমূহ
ভাইরাল হেপাটাইটিস
হেপাটাইটিস এ, বি, এবং সি ভাইরাস লিভারের কোষগুলোকে সংক্রমিত করে প্রদাহ সৃষ্টি করে, যাকে হেপাটাইটিস বলা হয়। এই প্রদাহ লিভারের কোষের ক্ষতি করে এবং বিলিরুবিনের মাত্রা বৃদ্ধি করে, যার ফলে জন্ডিস দেখা দেয়।
- হেপাটাইটিস এ: এটি দূষিত খাবার বা পানি গ্রহণের মাধ্যমে ছড়ায়।
- হেপাটাইটিস বি: এটি সংক্রমিত রক্ত বা শারীরিক তরলের সংস্পর্শে আসার মাধ্যমে ছড়ায়।
- হেপাটাইটিস সি: এটি সংক্রমিত রক্তের সংস্পর্শে আসার মাধ্যমে ছড়ায়।
অ্যালকোহল সেবনজনিত লিভারের রোগ
দীর্ঘস্থায়ী অ্যালকোহল সেবন লিভারের কোষগুলোকে ক্ষতিগ্রস্ত করে এবং লিভার সিরোসিসের দিকে পরিচালিত করে। লিভার সিরোসিস লিভারের কার্যকারিতাকে ব্যাহত করে এবং বিলিরুবিনের মাত্রা বৃদ্ধি করে, যার ফলে জন্ডিস দেখা দেয়।
ওষুধজনিত ক্ষতি
কিছু ওষুধ, যেমন প্যারাসিটামল এবং নির্দিষ্ট কিছু অ্যান্টিবায়োটিক, লিভারের কোষগুলোকে ক্ষতি করতে পারে। দীর্ঘস্থায়ী বা অতিরিক্ত ব্যবহারে জন্ডিস দেখা দিতে পারে।
অটোইমিউন হেপাটাইটিস
এই অবস্থায়, দেহের রোগপ্রতিরোধ ব্যবস্থা ভুলক্রমে লিভারের কোষগুলোকে আক্রমণ করে প্রদাহ সৃষ্টি করে। এই প্রদাহ লিভারের কার্যকারিতাকে ব্যাহত করে এবং বিলিরুবিনের মাত্রা বৃদ্ধি করে, যার ফলে জন্ডিস দেখা দেয়।
পিত্তনালীর বাধা
পিত্তনালিতে পাথর, টিউমার, বা সংকোচনের কারণে পিত্তরসের প্রবাহ ব্যাহত হতে পারে। পিত্তরস বিলিরুবিনকে শরীর থেকে বের করে দিতে সাহায্য করে। পিত্তরসের প্রবাহ ব্যাহত হলে বিলিরুবিনের মাত্রা বৃদ্ধি পায় এবং জন্ডিস দেখা দেয়।
অন্যান্য কারণ
- হেমোলাইটিক অ্যানিমিয়া: এই অবস্থায়, লাল রক্ত কণিকা দ্রুত ভেঙে যায়, যার ফলে বিলিরুবিনের মাত্রা বৃদ্ধি পায়।
- প্যানক্রিয়াটাইটিস: প্যানক্রিয়াটাইটিস পিত্তনালীতে প্রদাহ সৃষ্টি করতে পারে এবং পিত্তরসের প্রবাহ ব্যাহত করতে পারে।
- সিস্টিক ফাইব্রোসিস: এই জিনগত রোগ পিত্তনালীসহ বিভিন্ন অঙ্গকে প্রভাবিত করতে পারে।
জন্ডিসের লক্ষণ
ত্বক এবং চোখের সাদা অংশের হলুদ বর্ণ ধারণ
- বিলিরুবিন হলো লাল রক্ত কণিকা ভেঙে যাওয়ার ফলে তৈরি এক ধরণের হলুদ রঞ্জক পদার্থ।
- যখন লিভার সঠিকভাবে কাজ করে না, তখন বিলিরুবিন রক্তে জমা হতে থাকে এবং ত্বক ও চোখের সাদা অংশের হলুদ বর্ণ ধারণ করে।
- এই লক্ষণটিকে “ইক্টেরাস” বলা হয়।
প্রস্রাবের গাঢ় হলুদ বা বাদামী রং
- স্বাভাবিকভাবে, প্রস্রাব হালকা হলুদ রঙের হয়।
- যখন রক্তে বিলিরুবিনের মাত্রা বেড়ে যায়, তখন প্রস্রাবেও এর উপস্থিতি বেড়ে যায়।
- এর ফলে প্রস্রাবের রঙ গাঢ় হলুদ বা বাদামী রঙ ধারণ করে।
মলের ফ্যাকাশে রং
- পিত্তরস বিলিরুবিনকে শরীর থেকে বের করে দিতে সাহায্য করে।
- যখন পিত্তরসের প্রবাহ ব্যাহত হয়, তখন মলে বিলিরুবিনের পরিমাণ কমে যায়।
- এর ফলে মল ফ্যাকাশে রঙ ধারণ করে।
অন্যান্য লক্ষণ
- অরুচি এবং বমি ভাব: লিভারের কার্যকারিতা ব্যাহত হলে হজম প্রক্রিয়াও ব্যাহত হয়।
- পেটে ব্যথা বা অস্বস্তি: পিত্তনালীতে বাধা থাকলে পেটে ব্যথা বা অস্বস্তি হতে পারে।
- জ্বর এবং কাঁপুনি: কিছু ক্ষেত্রে, জন্ডিস জ্বর এবং কাঁপুনির সাথেও দেখা দিতে পারে।
- দুর্বলতা এবং অবসাদ: জন্ডিসের কারণে দুর্বলতা এবং অবসাদ অনুভূত হতে পারে।
উল্লেখ্য যে
- উপরে উল্লেখিত লক্ষণগুলি সবসময় একসাথে দেখা দেয় না।
- কিছু ক্ষেত্রে, লক্ষণগুলি খুব হালকা হতে পারে এবং তেমন বোঝা নাও যেতে পারে।
- অন্যদিকে, কিছু ক্ষেত্রে লক্ষণগুলি তীব্র হতে পারে।
আপনার যদি জন্ডিসের কোনো লক্ষণ দেখা দেয়, তাহলে দ্রুত একজন ডাক্তারের সাথে পরামর্শ করা উচিত।
এই লক্ষণগুলি ছাড়াও, জন্ডিসের আরও কিছু লক্ষণ হতে পারে, যেমন
- মাথাব্যথা I
- মাংসপেশীর ব্যথা I
- চুলকানি I
- ওজন কমানো I
- পায়ে ফোলা I
জন্ডিসের লক্ষণগুলি উপেক্ষা করা উচিত নয়, কারণ এটি গুরুতর স্বাস্থ্য সমস্যার লক্ষণ হতে পারে।
আপনার যদি জন্ডিসের কোনো লক্ষণ দেখা দেয়, তাহলে দ্রুত একজন ডাক্তারের সাথে পরামর্শ করা উচিত।
জন্ডিসের রোগ নির্ণয়
জন্ডিসের সঠিক কারণ নির্ণয় করা চিকিৎসার ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। একজন চিকিৎসক নিম্নলিখিত পরীক্ষা-নিরীক্ষাগুলোর মাধ্যমে জন্ডিসের কারণ নির্ণয় করতে পারেন:
শারীরিক পরীক্ষা
- চিকিৎসক আপনার ত্বক ও চোখের সাদা অংশে হলুদ বর্ণের উপস্থিতি পর্যবেক্ষণ করবেন।
- লিভারের আকার বৃদ্ধি পেয়েছে কিনা এবং স্পর্শে কোমল আছে কিনা তাও পরীক্ষা করা হবে।
রক্ত পরীক্ষা
- রক্ত পরীক্ষার মাধ্যমে বিলিরুবিনের মাত্রা পরিমাপ করা হয়।
- লিভার এনজাইমের মাত্রাও পরীক্ষা করা হয়।
- হেপাটাইটিস ভাইরাসের উপস্থিতি নির্ণয়ের জন্যও রক্ত পরীক্ষা করা হয়।
ইমেজিং পরীক্ষা
আল্ট্রাসাউন্ড, সিটি স্ক্যান, বা এমআরআই স্ক্যান লিভারের সংক্রমণ, টিউমার, বা পিত্তনালীর বাধার মতো অন্তর্নিহিত সমস্যাগুলি শনাক্ত করতে সহায়তা করে।
লিভার বায়োপসি
কিছু ক্ষেত্রে, লিভারের একটি ছোট অংশের নমুনা পরীক্ষার মাধ্যমে রোগ নির্ণয় করার প্রয়োজন হতে পারে।
নিম্নলিখিত পরীক্ষাগুলিও জন্ডিসের কারণ নির্ণয়ের জন্য ব্যবহার করা যেতে পারে
- পিত্ত পরীক্ষা: পিত্তরসের প্রবাহ এবং পিত্তথলির কার্যকারিতা পরীক্ষা করা হয়।
- হিমোগ্লোবিন পরীক্ষা: হিমোলাইটিক অ্যানিমিয়া জন্ডিসের কারণ কিনা তা নির্ণয় করা হয়।
- জিনগত পরীক্ষা: কিছু জিনগত রোগ জন্ডিসের কারণ হতে পারে।
রোগ নির্ণয়ের পর, চিকিৎসক জন্ডিসের কারণের উপর নির্ভর করে চিকিৎসার পরিকল্পনা নির্ধারণ করবেন।
কিছু ক্ষেত্রে, জন্ডিসের কোনো স্পষ্ট কারণ পাওয়া যায় না। এই পরিস্থিতিকে “অজানা কারণে জন্ডিস” বলা হয়। অজানা কারণে জন্ডিসের ক্ষেত্রে, চিকিৎসক লিভারের ক্ষতি রোধ করতে এবং জটিলতা প্রতিরোধ করতে সহায়তা করার জন্য ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন।
জন্ডিসের রোগ নির্ণয়ের ক্ষেত্রে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। যদি আপনার জন্ডিসের কোনো লক্ষণ দেখা দেয়, তাহলে দ্রুত একজন চিকিৎসকের সাথে পরামর্শ করা উচিত।
লিভার জন্ডিসের চিকিৎসা
লিভার জন্ডিসের চিকিৎসা অন্তর্নিহিত কারণের উপর নির্ভর করে। চিকিৎসার লক্ষ্য হলো লিভারের স্বাভাবিক কার্যকারিতা ফিরিয়ে আনা এবং জন্ডিসের উপসর্গগুলো নিয়ন্ত্রণ করা। কিছু চিকিৎসা বিকল্পের মধ্যে রয়েছে:
- অ্যান্টিভাইরাল ওষুধ: হেপাটাইটিস বি এবং সি এর জন্য অ্যান্টিভাইরাল ওষুধ লিভারকে আরও ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা করতে পারে এবং জন্ডিসের উপসর্গ কমিয়ে আনতে পারে।
- অ্যালকোহল থেকে বিরত থাকা: মদ্যপানজনিত লিভারের রোগের ক্ষেত্রে, অ্যালকোহল গ্রহণ সম্পূর্ণরূপে বন্ধ করা অপরিহার্য।
- ওজন নিয়ন্ত্রণ: অতিরিক্ত ওজন বা স্থূলতা লিভারের ওপর চাপ সৃষ্টি করে ক্ষতির সম্ভাবনা বাড়িয়ে তোলে। সুতরাং, আদর্শ শরীরের ওজন বজায় রাখা উচিত।
- ওষুধের পর্যালোচনা: আপনার সেবন করা ওষুধের মধ্যে যদি এমন কোনো ওষুধ থাকে যা লিভারের জন্য ক্ষতিকারক, তাহলে আপনার চিকিৎসকের সাথে আলোচনার মাধ্যমে বিকল্প থাকলে সেগুলো নেওয়ার চেষ্টা করা উচিত।
- সহায়ক চিকিৎসা: জন্ডিসের নির্দিষ্ট কিছু উপসর্গ যেমন ত্বকের চুলকানি বা বমি ভাবের জন্য চিকিৎসক আপনাকে ওষুধ দিতে পারেন।
- লিভার প্রতিস্থাপন: লিভারজনিত জটিলতায় বা লিভার বিকল হয়ে গেলে লিভার প্রতিস্থাপন সার্জারী বিবেচিত হতে পারে।
জীবনযাপনে পরিবর্তন
চিকিৎসার পাশাপাশি নিম্নলিখিত জীবনযাপনে পরিবর্তনগুলি লিভারের স্বাস্থ্য উন্নত করতে এবং জন্ডিসের ঝুঁকি কমাতে সহায়তা করে:
- স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস: ফল, শাকসবজি, গোটা শস্য এবং চর্বিহীন প্রোটিন সমৃদ্ধ একটি সুষম খাদ্য গ্রহণ করুন। প্রক্রিয়াজাত খাবার, চিনিযুক্ত পানীয়, এবং অতিরিক্ত চর্বি যুক্ত খাবারগুলো পরিহার করুন।
- নিয়মিত ব্যায়াম: সপ্তাহের বেশিরভাগ দিনে কমপক্ষে ৩০ মিনিট মধ্যম-তীব্রতার শারীরিক কার্যকলাপে লিপ্ত হোন।
- হেপাটাইটিসের টিকা গ্রহণ: হেপাটাইটিস এ এবং বি থেকে সুরক্ষার জন্য টিকা নিন।
- নিরাপদ যৌনাচার: অনিরাপদ যৌনাচার পরিহার করুন এবং নতুন যৌনসঙ্গীর ক্ষেত্রে যথাযথ সতর্কতা অবলম্বন করুন, কারণ হেপাটাইটিস বি একটি যৌনবাহিত রোগ হতে পারে।
- অনিরাপদ ইনজেকশন এড়িয়ে চলুন: কখনোই সূঁচ ভাগাভাগি করবেন না, বিশেষ করে যদি মাদকসেবনের ক্ষেত্রে সূঁচ প্রয়োগের প্রশ্ন আসে। নিরাপদ ইনজেকশন পদ্ধতি অনুসরণ করা অত্যাবশ্যক।
উপসংহার
লিভার জন্ডিস একটি গুরুতর চিকিৎসা পরিস্থিতি যার অবিলম্বে চিকিৎসা করা প্রয়োজন। উপসর্গগুলো শুরু হওয়ার সাথে সাথে একজন চিকিৎসকের সাথে পরামর্শ করা অত্যাবশ্যক। প্রাথমিক রোগ নির্ণয় এবং উপযুক্ত চিকিৎসা লিভারের অতিরিক্ত ক্ষতি প্রতিরোধ করতে পারে এবং সম্পূর্ণ সুস্থ হতে সহায়তা করে।
মনে রাখতে হবে: এই তথ্য শুধুমাত্র আপনাকে সম্ভাব্য সমস্যা সম্পর্কে অবগত করার উদ্দেশ্যে প্রণীত। জন্ডিস বা লিভারের অন্য কোনো স্বাস্থ্য সমস্যা হলে দয়া করে একজন যোগ্য চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।